ধীরে নামছে বন্যার পানি

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৪, ১০:৫৩ এএম
ধীরে নামছে বন্যার পানি

ঢাকা : বর্ষা মৌসুমের পর শরতে এসে চলমান যে বন্যায় দেশের অন্তত ১১টি জেলা ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত, আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষায় এটি ছিল ‘আকস্মিক বন্যা’।

এ ধরনের বন্যায় সাধারণত একদম কম সময়ের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে যায়, আবার সেই পানি নেমেও যায় খুব দ্রুত।

তবে এবারের ‘আকস্মিক বন্যা’ দেখাচ্ছে ভিন্ন রূপ। প্রায় এক সপ্তাহ আগে ফেনীসহ দেশের যে জেলাগুলো প্লাবিত হয়েছে, সেখান থেকে এখনও পানি নামছে না; কোথাও নাম শুরু হলেও তাতে রয়েছে ধীর গতি।

রোববার (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি প্রায় একই রকম থাকার পরিপ্রেক্ষিতে পানি নামার ধীরগতির বিষয়ে আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, মূলত চারটি কারণে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে।

তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সীমান্তের দুই পাশে চট্টগ্রাম বিভাগ ও ভারতের ত্রিপুরায় একই সময়ে অতিভারী বৃষ্টিপাত, পাহাড় থেকে নেমে আসা হড়কা বান, সাগরে জোয়ারের স্থিতি এবং বন্যার মধ্যে বৃষ্টি অব্যাহত থাকার ঘটনাগুলো বন্যার পানি ধীরে নামার কারণ।

এসব কারণে সপ্তাহ পার হতে চললেও বন্যার পানি সেভাবে নামছে না। রোববারও এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ কিছু দেখা যায়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রোববার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্যা উপদ্রুত এলাকায় গড়ে ২০-৩০ সেন্টিমিটার পানি কমেছে।

কেন্দ্রটির নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান রোববার (২৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় বলেন, পানি কমার এই হারকে ধীর থেকে মাঝারি বলা যায়। অন্যান্যবারের আকস্মিক বন্যার তুলনায় এবার পানি কমার হার ধীর।

এবারের বন্যার পানি ধীরে নামার দুটি কারণের কথা বলছেন উদয় রায়হান। তিনি বলছেন, এর একটা হচ্ছে তিন থেকে চার দিন ধরে ব্যাপক বৃষ্টিতে আমাদের দেশে যেমন বন্যা হয়েছে, উজানেও বন্যা হয়েছে। এ জন্যই এখন সমতল থেকে যে পানিটা নামছে, এটা ধীরে নামছে।

আরেকটা কারণ হচ্ছে, এখনও বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। তবে, এটা আগের মতো ব্যাপক না কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে, পানি নামলেও খুব বেশি কমছে না।

তবে পরশু মঙ্গলবার থেকে এটা স্বাভাবিক গতিতে নামার সম্ভাবনা আছে; যোগ করেন উদয় রায়হান।

নদ-নদীর পানির প্রবাহ রোববার যে অবস্থা পাওয়া গেছে, তাতে উদয় রায়হানের বক্তব্যের মিল রয়েছে। এখনও অনেক নদীর পানি বিদৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কোথাও বাড়ছে পানি, যার মধ্যে চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলা অন্যতম, যেখানকার চারটি ইউনিয়নে রোববারও বন্যার পানি বৃদ্ধির তথ্য রয়েছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, রোববার (২৫ আগস্ট) সকাল ৯টা থেকে সিলেটের অমলশীদ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। ২৪ ঘণ্টায় এই নদীর পানি মাত্র ১ সেন্টিমিটার কমেছিল।

শেরপুর-সিলেট, মারকুলী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩ ও ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে কুশিয়ারার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।

তবে ২৪ ঘণ্টায় এই দুই পয়েন্টে কুশিয়ারার পানি কমেছে যথাক্রমে ৬ ও ২ সেন্টিমিটার।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরও যে তথ্য দিচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে সিলেটের মনু নদীর পানি রোববার সকাল ৯টায় মৌলভীবাজার পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যদিও এ দিন ২৪ ঘণ্টায় এই নদীর পানি কমেছে ৬৮ সেন্টিমিটার।

কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। রোববার (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় এই নদীর পানি কমেছে ১৮ সেন্টিমিটার।

রোববার (২৫ আগস্ট) সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে টেকনাফে ৩৫, নাইক্ষ্যংছড়িতে ২৪, লামায় ১৫, আনোয়ারায় ১৯, নোয়াখালীতে ১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।

এবারের বন্যা এখন পর্যন্ত যে ১১টি জেলায় আঘাত হেনেছে, তার মধ্যে অন্যতম ফেনী। বন্যায় এই জেলার অন্যান্য এলাকার পাশাপাশি সদরের জনপদও জলমগ্ন হয়ে আছে।

পুরো এলাকার ৬৫৩টি মোবাইল টাওয়ারের মধ্যে এখনও ৫৮৮টি টাওয়ার অচল। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তীব্র পানির স্রোতের জন্য এবং বিদ্যুৎ না থাকায় এসব টাওয়ার সচল করা যাচ্ছে না বলে তথ্য রয়েছে। সড়ক যোগাযোগও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

সব মিলে এখন এক প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জেলা ফেনী। এ জন্য ফেনীর যে মুহুরী নদী রুদ্র রূপ ধারণ করে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, সে নদীর পানি প্রবাহের কোনো তথ্য নেই পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কাছে।

ফেনী ছাড়াও বন্যা উপদ্রুত অন্য জেলাগুলো হল নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও কক্সবাজার।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য নুযায়ী, ১৭ ও ১৮ অগাস্ট থেকে বঙ্গোপসাগর এবং এর পশ্চিম উপকূলে মৌসুমী লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। লঘুচাপ টানা দুই দিন সেখানে অবস্থান করে। সে সময় দেশের উপকূল ও দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়। নদ-নদীর পানি এরপরই বাড়তে থাকে।

অধিদপ্তরের পূর্বাভাস ছিল, এই লঘুচাপটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিহারের দিকে যাবে। কিন্তু লঘুচাপটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে এটি দেশের মধ্যাঞ্চলে ২০ অগাস্ট পর্যন্ত থেকে যায়। সে সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যায় আরও বেড়ে। এরপর ২০ অগাস্ট রাতে ভারী বৃষ্টি হয়। এর প্রভাবেই ‘আকস্মিক বন্যা’র সৃষ্টি হয়।

কিন্তু অতিপ্রবল বৃষ্টিপাতের এই প্রবণতার পেছনে কারণ কী, এ নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদী ও পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তিনি বলছেন, ক্লাইমেট চেঞ্জের (জলবায়ু পরিবর্তন) কারণে সব কিছুই বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। এবার সিলেট থেকে একেবারে বান্দরবান পর্যন্ত বন্যা হয়েছে। যে লঘুচাপ ছিল, সেটা ওখানে মুভ করেছে। আগের যে বাতাসের মুভমেন্টের নির্দিষ্ট তারিখ ছিল, সেটা নাই এখন। এ জন্যই আকস্মিক এত বৃষ্টিপাত হয়েছে।

জয়বায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের দিক থেকে তিনি বলেন, আগে চৈত্র সংক্রান্তিতে বৃষ্টি হতো। জৈষ্ঠ্যের শেষ তিন দিন আর বৈশাখের প্রথম চার দিন বৃষ্টি হতে দেখা যেত, কালবৈশাখী হতো। এখন সেটা হচ্ছে না।

দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন বদলে যাওয়া জলবায়ুর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে। এ কারণে আবহাওয়ার মৌসুমী চরিত্র বদলে যাচ্ছে।

অধ্যাপক আইনুন নিশাতও বলছেন এমন কথা, তার ভাষায়- এবার আকস্মিক বন্যা হলেও এটা হচ্ছে ফ্ল্যাশ ফ্লাড (হড়কা বান), পাহাড়ি এলাকা থেকে পানি নেমে এসেছে সমতলে। ফলে এটা নামবেও ধীরে-ধীরে।

ঋতুভিত্তিক আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় জুলাইয়ে।

তবে এবার জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম বৃষ্টিপাত হয়েছে জানিয়ে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক রোববার রাতে বলেন, জুলাই মাসে এবার স্বভাবিকের তুলনায় কিছুটা কম বৃষ্টিপাত হলেও ১৬ থেকে ২২ অগাস্ট ভারী বর্ষণ হয়েছে। একদিকে উজানে ত্রিপুরায় ভারী বর্ষণ, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরেও ব্যাপক বৃষ্টি- এই দুইয়ে মিলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়।

কিন্তু বন্যার পানি কেন ধীর নামছে, এমন প্রশ্নে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার পর থেকেই সাগরে জোয়ারের উচ্চতা বেশি আছে, যে কারণে পানি ধীরে নামছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই রোববার আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির প্রবণতা মঙ্গলবার পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে বলে তথ্য এসেছে।

পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম এই তিন বিভাগে ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ ছাড়া ঢাকা, সিলেটের অনেক জায়গা এবং রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের কিছু জায়গায় মাঝারি ধরনের বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

বন্যা উপদ্রুত জেলাগুলো থেকে পানি ধীরে নামার কারণগুলোর মধ্যে আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বন্যার মধ্যেই বৃষ্টি হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বে নিয়ছেন। ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির আভাস বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ভালো খবর নাও হতে পারে।

এমটিআই

Link copied!