রাজনীতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে!

  • তুষার আচার্য্য, রংপুর | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২৪, ০৮:৫৯ পিএম
রাজনীতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে!

ফাইল ছবি

রংপুর: ‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’ -শিক্ষা গুরুর মর্যাদা কবিতায় কবি কাজী কাদের নেওয়াজ এভাবেই শিক্ষকের প্রতি বাদশাহ্ আলমগীরের সম্মান ও শ্রদ্ধার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষকদের সম্মানে যেমন ভাঁটা পড়েছে তেমনি নষ্ট হয়েছে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যকার মধুর সম্পর্ক। মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক শুধুমাত্র পুঁথিগত। 

মহান শিক্ষক দিবসে কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষকদের প্রতি তাদের সম্মান শ্রদ্ধার কথা। কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী হাসিবুল হাসান বসুনিয়া বলেন,“কারমাইকেল কলেজের ইতিহাস অনেক উচ্চ পর্যায়ের।কিন্তু এ কলেজে আসার পর দেখছি,যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল এই কলেজের অনেক শিক্ষকই লেজুরবৃত্তি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। যা কোনভাবেই কাম্য ছিল না। আমাদের শিক্ষার্থীদের একটাই চাওয়া ছিল শিক্ষক হবে শিক্ষার্থীবান্ধব। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় আমাদের অনেক দাবি-দাওয়া শিক্ষকরা পূরণ করতে পারতেন না। শিক্ষকদের এই লেজুরবৃত্তি রাজনীতি করার কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। রাজনীতি মূলত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দূরত্ব তৈরি করেছে।

শিক্ষার্থী হাসিবুল হাসান বসুনিয়া ও রিফাত জাহান রাকা
কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী হাসিবুল হাসান বসুনিয়া ও রিফাত জাহান রাকা।

কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী রিফাত জাহান রাকা বলেন, ‘বর্তমান সময় এমন হয়ে গেছে যখন আমাদের ছাড়া আমাদের সামনে দিয়ে যায় তখন সালাম দেয়ার ভয়ে আমরা লুকিয়ে পড়ি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সম্পর্কটা সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনেই এটা হচ্ছে। সঠিক শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার মানোন্নয়ন করলে হয়তো শিক্ষকদের সাথে আমাদের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কটা আবার আগের মত হয়ে যাবে।’

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী মোহাইমিনুর ইসলাম বলেন, “আগে আমরা যখন লেখাপড়া করতাম তখন শিক্ষকদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা ছিল একটু অন্যরকম। একদিকে শিক্ষকরা আমাদের যেরকম শাসন করতো অন্যদিকে তেমন আদরও করতো। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। এখন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শাসন করে না অপরদিকে শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষকদের সম্মান করে না। কিন্তু শিক্ষকরাই আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের মূল চাবিকাঠি টা দিয়ে দেয়।  তাই আমাদের উচিত শিক্ষকদের সম্মান দেয়া।”

মোহাইমিনুর ইসলাম ও মেরাজুল ইসলাম
মোহাইমিনুর ইসলাম ও মেরাজুল ইসলাম।

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী মেরাজুল ইসলাম বলেন, “বর্তমান শিক্ষকদের যেভাবে অপমানিত লাঞ্ছিত করা হচ্ছে এটা খুবই হতাশা জনক। শিক্ষকরা ভুল করলেও তারা আমাদের শিক্ষক। তাই বলে তাদের এভাবে অপমান করা উচিত নয়। কিছুদিন আগে রংপুরে শিক্ষককে জুতার মালা গলায় দেয়া হয়েছিল, একজন শিক্ষার্থীর হয়ে এটা দেখার পরে খুব কষ্ট পেয়েছি। যখনই শিক্ষকের হাত থেকে বেত তুলে নেয়া হয়েছে তখন থেকেই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়েছে।”

শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার বিষয়ে কারমাইকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক জনি মোহাম্মদ বলেন,“বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার যে আধুনিকায়ণ হচ্ছে তার সাথে হয়তো আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না।এর কারনে আমাদের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনেক কম। তাই তাদের সাথে যে আমাদের বন্ধনটি সেটি তৈরি হচ্ছে না। আমিও এক সময় শিক্ষার্থী ছিলাম, আমার শিক্ষকের সাথে আমার যে মধুর সম্পর্ক তা এখনো আছে। কিন্তু এই সময় এসে আমার শিক্ষার্থীর সাথে সেটি হচ্ছে না। কারণ শিক্ষা এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে সে কারণেই তারা এখন ক্লাস বিমুখ হয়েছে।

কারমাইকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক জনি মোহাম্মদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এম এ রউফ খান
কারমাইকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক জনি মোহাম্মদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এম এ রউফ খান।

কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এম এ রউফ খান বলেন,“বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, এতে একপক্ষ সুবিধা নিচ্ছে।  কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্তঃসম্পর্কে প্রভাব পড়ছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্কটা যে নষ্ট হয়েছে এমন নয় তবে আগে যেরকমটা ছিল সেরকমটা নেই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে জেনারেশন গ্যাপ। এখন যারা শিক্ষক তারা আগের জেনারেশনের আর শিক্ষার্থী বর্তমান জেনারেশনের। শিক্ষার্থীরা এখন প্রযুক্তি নির্ভর, তারা অত্যাধুনিক।প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ার ফলে মূল্যবোধ, সামাজিকতা, মানবিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সামাজিক বন্ধন এটি শুধুমাত্র শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয় সামাজিকভাবে ও পারিবারিকভাবেও কমে গিয়েছে। তার প্রভাবেই আমাদের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ে গিয়েছে।”

কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোস্তাফিজার রহমান
কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোস্তাফিজার রহমান।

কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোস্তাফিজার রহমান বলেন, “শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার যে সম্পর্কটা সেটা আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। যার মূল কারণ হিসেবে আমি মনে করি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম উপস্থিতি। শিক্ষার্থীরা এখন ক্লাস না করেও পরীক্ষায় পাস করতে পারে। যার ফলে শিক্ষকদের সাথে তাদের সম্পর্কটা তৈরিই হয় না। তবে এতে শিক্ষকদেরও কিছু ভুল আছে। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করতে না পারে তাহলে তো শিক্ষার্থী ক্লাসে আসবে না আর সম্পর্কও তৈরি হবে না। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দুই পক্ষকেই আন্তরিক হতে হবে পারস্পারিকের সম্পর্কটি তৈরি করার জন্য এবং টিকিয়ে রাখার জন্য।”

এসএস

Link copied!