ঢাকা : দায়িত্ব নিয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের পরেই পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন। এই সংস্কার করতে ছয়টি কমিশনও গঠন করেছেন। সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে সিভিল রাইটস গ্রুপ সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তার নেতৃত্বে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের একটি কমিটি গঠিত হবে, সেই কমিটি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় পুরোপুরি পর্যালোচনা করবে। সেই সাথে নির্বাচনি আইন থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যেসব ত্রুটি রয়েছে সেগুলো সংশোধন করে নতুন একটি প্রস্তাবনা তৈরি করবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে সরকার গঠিত কমিশনের সভাপতি মি. মজুমদার বলেন, যে সব জায়গায় সংস্কার করা দরকার তা করতে আমাদের কমিশন কাজ করবে। তবে কি কি পরিবর্তন আনবো সেটি চূড়ান্ত করবে পূর্ণাঙ্গ কমিশন।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবি বহু পুরোনো।
বিশেষ করে ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে বাংলাদেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের করার পর দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে গত এক দশকে।
তাই আগামীতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে সবার আগে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কিংবা এ বিষয়ে সংবিধান সংশোধন কমিটি কী সিদ্ধান্ত নেয় সেদিকে তাকিয়ে থাকবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংবিধানের বিষয়টি থাকবে মৌলিক। সংবিধান সংস্কার করা হলে তার ওপর ভিত্তি করেই অন্য কাজগুলো করতে হবে।
এই কমিশন এরই মধ্যে সংস্কারের জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন পদ্ধতি, নির্বাচনি আইন কিংবা নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের বিধানগুলোতেও সবার আগে নজর দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যেভাবে কাজ শুরু করবে কমিশন : গত ১১ই সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ছয়টি সংস্কার কমিশন ঘোষণা করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বদিউল আলম মজুমদারকে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি কমিটির অন্য সদস্য কারা থাকবেন।
তবে কমিটি চূড়ান্ত না হলেও এরই মধ্যে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যারা কাজ করে এমন ব্যক্তিদের সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করেছেন কমিশন চেয়ারম্যান মি. মজুমদার।
এই সংস্কার কমিশনে সদস্য সংখ্যা কতজন থাকবে সেটি এখনো চূড়ান্ত না হলেও জানা গেছে এর সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ আট থেকে দশজন হতে পারে।
মি. মজুমদার বলেন, “আমরা এখনো এটি চূড়ান্ত করিনি। চূড়ান্ত করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবে এই কমিশন।
কাজ শেষে তারা আগামী ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মণ্ডলী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কারের ধারণা নিয়ে আলোচনা শুরু করবে।
তারপর এ নিয়ে পরামর্শমূলক মতবিনিময় করা হবে; যেখানে সমাজের সব পর্যায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
সব কাজ শেষে চূড়ান্ত করতে কতদিন সময় লাগবে সেটি কি আগামী দেড় বছরের মধ্যে সম্ভব কী না এমন প্রশ্নে বিশ্লেষক তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটা অনেক বড় কর্মযজ্ঞ। এত অল্প সময়ে তা সম্ভব না। তবে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করে বাকিটা নির্বাচিত সরকারের কাছেও সুপারিশ করা যেতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের শপথ গ্রহণের দিন।
নির্বাচন ব্যবস্থায় কি কি সংস্কার?
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ার পর দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে একতরফাভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, কখনো ভোট কারচুপি, কখনো ‘ডামি প্রার্থী’ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করার মতো অভিযোগ উঠেছে।
এখন সে অবস্থা থেকে সরে এসে নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সংবিধানে পরিবর্তন আনার ওপর সবার আগে জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, আপনি যদি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল না করেন তাহলে সংস্কারে এক ধরনের হিসাব, না হলে আরেক ধরনের হিসাব। কারণ এর ওপর নির্ভর করছে অনেক সংস্কার।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটি নির্বাচনি আইন গণপ্রতিধিত্ব আদেশ বা আরপিও সংস্কার, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, পর্যবেক্ষক নিয়োগসহ আইন কাঠামোগুলো পর্যালোচনা করে তার সেগুলো কি কি সংস্কার আনা যায় সেটি চূড়ান্ত করবে।
নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বলেন, নির্বাচন নিয়ে আইনি কাঠামো যা আছে সেগুলো সংস্কার করা খুব জরুরি। অর্থাৎ পুরো নির্বাচনি প্রক্রিয়া রিভিউ করতে হবে।
এক্ষেত্রে শুধু নির্বাচনের আগে না, ভোটের পরও নির্বাচনি বিরোধগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকে সেগুলো নানা সংকটে সমাধান হয় না, সে সব বিষয়ও এই পর্যালোচনায় উঠে আসতে পারে।
কমিশন চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখনো কোন কিছুই চুড়ান্ত না। আগে তো পর্যালোচনা ও কাজ শুরু করতে হবে। সেটা যতক্ষণ না হয় ততক্ষণ তো বলা যাবে না কি কি আমরা চাই।
গত বছর আরপিও সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। এছাড়া সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন সেটি নিয়ে সবসময় বিতর্ক দেখা যায়।
ফলে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে হলে সংস্কার প্রস্তাবনায় নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
‘না’ ভোট ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে প্রশ্ন
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর ২০১৪ সালের পাঁচই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর আওয়ামী লীগের অধীনে পাঁচই জানুয়ারির ওই নির্বাচনে যায় নি বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক রাজনৈতিক দল।
যে কারণে একতরফা ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করেন। অর্থাৎ ভোটের আগেই আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
২০০৭ সালে ড. এটিএম শামছুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন তখন বেশ কিছু নির্বাচনি সংস্কার করেছিল।
তাদের উদ্যোগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো না ভোট চালু করা হয়।
পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইন সংশোধন করে বাতিল করা হয় ‘না’ ভোট।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলছিলেন, যদি ‘না’ ভোট তখন বাতিল করা না হতো, তাহলে হয়তো এত বিশাল সংখ্যক আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারতো না। নির্বাচনে কিছু মানুষ কেন্দ্রে যেতো।
গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের ভোটিং পদ্ধতি নিয়ে যত আলোচনা ও রাজনৈতিক বির্তক হয়েছে তা অন্য কোন ইস্যুতে আর হয় নি।
কেননা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন বিভিন্ন সময় ইভিএম’- এ ভোট আয়োজনের কথা বলেছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম’- এ ভোটের মাধ্যমে কিছু কিছু জায়গায় ইসির কিছু সফলতা ছিল।
কিন্তু গত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তারা অর্ধেক আসনে ইভিএম’এ ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছু হটেছে। আর ইভিএম ব্যবহার করেনি আউয়াল কমিশন।
নতুন কমিশন গঠনের পর নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার সংস্কারের শুরুতেই তাই গুরুত্ব পাবে নির্বাচন পদ্ধতি।
সেক্ষেত্রে ভোটিং ব্যবস্থা আরো আধুনিক করা যায় কি না সে বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে আলোচনায়, বলছিলেন অধ্যাপক আহমেদ।
একই সাথে তিনি বলেন, 'প্রবাসী ভোটাররা কখনো ভোট দিতে পারে না বিধান না থাকার কারণে। আমার মতামত হচ্ছে তাদের সে সুযোগ থাকা উচিত। এক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে।
নির্বাচন কমিশন গঠন হবে কীভাবে?
বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর গত এক যুগে বিভিন্ন সময় দেশের নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে নানা প্রশ্ন আলোচনায় এসেছে।
আলোচনা সমালোচনার এক পর্যায়ে ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।
ওই সার্চ কমিটির সুপারিশে নিয়োগ হয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশন। যারা চলতি সেপ্টেম্বরে পদত্যাগ করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশন তাদের কাজে কতটুকু নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছে।
জবাবে বিশ্লেষক মি. আলীম বলেন, এই কারণেই আমাদের নজর দিতে হবে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইনের দিকে। এটাও জরুরি বিষয়।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে শুরু করে গত ১৭ বছরে চারটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে।
প্রতিটি কমিশনের দায়িত্বে যারা ছিল তাদের মধ্য থেকে অন্তত একজন সাবেক সরকারি আমলা, একজন সাবেক বিচারক ও সাবেক সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা কমিশনার/প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেতো।
তবে এই পদ্ধতিকেই ত্রুটি হিসেবে দেখছেন অধ্যাপক আহমেদ। তিনি বলেন, এটা কোন আইন? কিসের ভিত্তিতে এটি করতো তারা? নতুন সংস্কারের সময় এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অতীতের কমিশনগুলো সেটি না পারার কারণে এত প্রশ্ন উঠছে।
তাহলে কি কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটি আছে? এর সংস্কার দরকার?
জবাবে কমিশন চেয়ারম্যান মি. মজুমদার বলেন, আমাদের পর্যালোচনায় সব বিষয়ই আসবে। কমিশনার ও সিইসি নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে আইনের বিষয়গুলোও আমরা দেখবো। সূত্র : বিবিসি
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :