মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটছে ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ জব্বারের

  • মাহমুদুর রহমান রনি, পাথরঘাটা | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৪, ০২:৪৮ পিএম
মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটছে ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ জব্বারের

বরগুনা: নর্দান ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বরগুনার পাথরঘাটার আব্দুল জব্বার। শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। গত ৫ই আগস্ট সোমবার বিকাল ৩টার দিকে আশুলিয়ায় ছাত্র আন্দোলনে বুকে, মাথা ও কোমরে গুলিবিদ্ধ হন জব্বার। পরে পাশে থাকা জব্বারের বন্ধুরা স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। চিকিৎসক অস্ত্রপচারের মাধ্যমে তার মাথায় ও বুকে বিদ্ধ বুলেট বের করেন। তবে কোমরে বিদ্ধ হওয়া বুলেটটি বের করতে পারেননি। দুইদিন হাসপাতালে রাখার পরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয় জব্বারকে। দুই ভাইবোনের মধ্যে জব্বার বড়। তার মা প্রবাসে থাকেন। জব্বারের বাড়ি বরগুনা পাথরঘাটার কাঠালতলী ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের কালিপুর কালীবাড়ি।

 

আব্দুল জব্বার বলেন, ঢাকা মেডিকেল ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানায় যে, যত দ্রুত সম্ভব গুলি বের করা না হলে আমার চিরদিনের জন্য পঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আমার এবং আমার পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। আর্থিক অবস্থার কারণে দুই মাসের অধিক হয়ে গেলেও আমার গুলি বের করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে আমার দিন কাটাছে।

ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সেদিন সকালে আশুলিয়া থেকে শাহবাগে যেতে চেয়েছিলাম। পরে কিছুক্ষণ থেকে বাসায় চলে আসি। আবার বাসা থেকে ইপিজেডের সামনে যাই। সেখানে প্রচুর ছাত্র-জনতা জড়ো হচ্ছিলো। আমি তাদের সঙ্গে মিছিলে যাই। আশুলিয়া থানার সামনে যাওয়ার পরে দেখি পুলিশের গুলিতে অনেকে আহত হয়েছে । শিক্ষার্থীরা আক্রমণ করার চেষ্টা করছিল এ সময় পুলিশ সদস্যরা মসজিদের দিকে চলে যায়। তখন তারা আমাদের ওপরে কিছু করবে না বলে জানায়। আমরা এ সময় মিছিল নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। তখন পুলিশ আমাদের একদম কাছাকাছি। এ সময় তারা আমাদের থানার দিকে নেয়ার চেষ্টা করে এবং গুলি ছুড়তে থাকে। আমরা শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনতা মিশ্রিত হয়ে যাই। এ সময় তারা আতঙ্কিত হয়ে গুলি করতে থাকে। বেশির ভাগ গুলিগুলো ছুঁড়েছে ছাদ এবং টাওয়ারের উপর থেকে। আমরা কখনো বুঝতে পারিনি এভাবে গুলি করবে। 

তিনি বলেন, জীবন বাঁচাতে সবাই এদিকে-সেদিকে ছোটাছুটি শুরু করেছে। এ সময় আমার শরীরে গুলিবিদ্ধ হয়। আহত হওয়ার পর আশুলিয়ার একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় সেখানে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা নেই। ব্যথা কমলে পরের দিন সকালে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে দুইদিন রেখে আমাকে ১৪ দিন পরে আবার হাসপাতালে যেতে বলেন। ১৪ দিন পর হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক জানান এটা অপারেশন করার দরকার নেই, যেভাবে আছে এভাবে থাকুক। অপারেশন করলে অনেক ঝুঁকি হয়ে যাবে। এরপর পিজিতে ভর্তি হই। সেখানে প্রায় ১০-১১ দিনের মতো ভর্তি ছিলাম। সেখানে চিকিৎসকরা একটি বোর্ড গঠন করেছিলেন। 

তারা জানান অস্ত্রপচার করলে প্যারালাইজড হওয়ার সম্ভাবনা আছে। না হলে বুলেট সেভাবে আছে সেভাবে থাকবে। আমার এখন চলাফেরা করতে সমস্যা হয়। হাঁটাচলা বেশি করলে পায়ে অনেক ব্যথা হয়। যদি বিদেশে যাওয়া লাগে তাহলে তো অনেক অর্থের প্রয়োজন। আর অপারেশনটি করলে যদি আরও খারাপ কিছু হয় সেজন্য চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আমার যদি কিছু হয় তাহলে আমার মা-বোনকে দেখবে কে?

তিনি বলেন, দুই বছর ধরে ঢাকায় থাকি। আমরা দুই ভাইবোন। একমাত্র বোন স্বর্ণাকে নিয়ে আশুলিয়াতে থাকি। সে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাবা আবুল কালাম আজাদ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন কোনো সম্পর্ক নেই। মা আরজু আক্তার খাদিজা আমাদের বড় করেছেন। মা এখন জর্ডানে থাকেন। আমার থার্ড সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে দিতে পারছি না। পড়াশোনায়ও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের ঠিকমতো মানুষ করার জন্য মা বিদেশে গেছেন। সবকিছুর খরচ তিনি বহন করে। আমি আগে একটা টিউশনি করতাম সেটি বাদ দিয়েছি। মা-বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। একসময় চিন্তা করতাম বিদেশ যাবো কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর থেকে মনে হচ্ছে দেশে থেকেই ভালো কিছু করবো। তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে হচ্ছে। মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা চলে আসে যে এই বুলেটটি শরীরে থাকলে ভবিষ্যতে বড় কোনো সমস্যা হবে কিনা। আগে একটা স্বাভাবিক শরীর নিয়ে চলাফেরা করেছি আর এখন ডিফারেন্ট। সবসময় মনে হয় আমার হিপ জয়েন্টের মধ্যে কিছু একটা আছে। আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলাম। আমার ইউনির্ভাসিটি থেকে কিছু সহযোগিতা করেছেন। তাছাড়া সমন্বয়কসহ অনেকে খোঁজখবর নিয়েছেন। তবে আর্থিকভাবে সহযোগিতা না পেলেও তারা পরামর্শ দিয়েছেন। আমি নিজেই আর্থিকভাবে সহযোগিতা চাইছি যদি বিদেশে যেতে হয় তখন তারা আমাকে সহযোগিতাটুকু করুক। আমার বেশি কিছু চাওয়ার নেই শুধু একটু সুচিকিৎসা দরকার। এখন আমার সকলের সহযোগিতা দরকার।

জব্বারের বোন স্বর্ণা বলেন, আমার ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল । আমাদের বাবা নেই। ভেবেছিলাম ভাইয়া লেখাপড়া করে সংসারে হাল ধরবে। কিন্তু ভাইয়াকে সঠিক চিকিৎসা না দিতে পারলে তো ভাইয়া আর ভালো হতে পারবে না। ভাইয়া যেন চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সেজন্য সকলের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি। 

এসএস

Link copied!