মাটির ঘর হয়েছে বিলাসবহুল ভবন

নিয়োগ-বদলি-টেন্ডার বাণিজ্য করেই টাকার কুমির সাবেক এমপি মনসুর-দারা

  • জনাব আলী, রাজশাহী | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২৪, ০৪:৫৮ পিএম
নিয়োগ-বদলি-টেন্ডার বাণিজ্য করেই টাকার কুমির সাবেক এমপি মনসুর-দারা

ডা. মনসুর রহমান ও আব্দুল ওয়াদুদ দারা

রাজশাহী: রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) সংসদীয় আসনের সদ্য সাবেক দুই সংসদ সদস্য ডা. মনসুর রহমান ও আব্দুল ওয়াদুদ দারা বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, নিয়োগ, টেন্ডার বাণিজ্যে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এদের মধ্যে মাত্র এক মেয়াদে (পাঁচ বছর) এমপি হয়েই নিয়োগ-বাণিজ্য করে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন ডা. মনসুর রহমান। এবিষয়ে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অপরদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনবারের এমপি সদ্য সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারা নিয়োগ, বদলি, টেন্ডার-বাণিজ্য এবং হাট-ঘাট লিজসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশন-বাণিজ্য করে বিগত ১০ বছরে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এলাকা থেকে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে রয়েছেন এই সংসদ সদস্যরা। কোটি টাকা কামিয়ে এখন ঘর ছাড়া হওয়ায়, তাদের সুখের সংসারে ঘুন ধরেছে বলে অভিযোগ স্থানীয় এলাকাবাসীদের। টাকায় সুখ থাকলেও এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারছেন না তারা।

শুধু নিয়োগ-বাণিজ্য করেই ডা. মনসুর রহমান শতকোটি টাকা কামিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসীরা। নিয়োগ-বাণিজ্যের পাশাপাশি অর্থ পাচার, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ডা. মুনসুরের বিরুদ্ধে। তবে সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে ডা. মনসুর সরে গেলে নৌকা প্রতীক পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দারা। আর এই দারা গত ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে টানা ১০ বছর এমপি ছিলেন। ওই সময় থেকে তিনি নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দল থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। কিন্তু একই রূপে ডা. মুনসুর আর্বিভূত হওয়ায় এক মেয়াদের পর ফের সংসদ সদস্য হন আব্দুল ওয়াদুদ দারা। সর্বশেষ এমপি দারা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এমপি থেকে প্রতিমন্ত্রী হয়ে তিনি আরও টাকার ‍কুমির বনে যান।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান ডা. মনসুর রহমান। সেই নির্বাচনে তিনি বার্ষিক আয় দেখান ১৪ লাখ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এমপি হয়েই প্রথমে এলাকার নন-এমপিও শিক্ষপ্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা তৈরি করেন তিনি। পরে এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে পুঠিয়ার চন্দনমাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসা এমপিও করে দেওয়ার নামে ২০ লাখ, সাধনপুর উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০ লাখ, সাধনপুর পঙ্গু শিশু নিকেতন ডিগ্রি কলেজ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া নিয়োগের নামেও চালান বাণিজ্য। এরই অংশ হিসেবে পুঠিয়া ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজে দুই দফায় ১৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। শুধু পুঠিয়ার ওই একটি কলেজে নয়, সাধনপুর পঙ্গু শিশু নিকেতন ডিগ্রি কলেজে চারটি পদে নিয়োগ দিয়ে ৪৮ লাখ টাকা, সাধনপুর পঙ্গু ও শিশু নিকেতন হাইস্কুল থেকে চারটি পদে নিয়োগে ৩২ লাখ টাকা, অমৃতপাড়া দাখিল মাদ্রাসার তিনটি পদে নিয়োগ দিয়ে ২৪ লাখ টাকা, সাতবাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসায় তিনটি পদে নিয়োগ দিয়ে ২০ লাখ টাকা, সাতবাড়িয়া হাইস্কুলে তিনটি পদে ২১ লাখ টাকা, পচামাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে চারটি পদে ২২ লাখ টাকা, পচামাড়িয়া হাইস্কুলে চারটি পদে ৪৮ লাখ, তেঁতুলিয়া হাইস্কুলে তিনটি পদে নিয়োগ দিয়ে ২০ লাখ টাকা নেওয়ার অভিয়োগ রয়েছে মনসুর রহমানের বিরুদ্ধে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিয়োগ-বাণিজ্য নির্বিঘ্ন করতে কলেজ পরিচালনা কমিটিতে তার ছেলেমেয়ে ও পছন্দের লোকজনকে বানিয়েছেন সভাপতি। তাদের মাধ্যমেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন ডা. মনসুর। মেয়ে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে গেলে ছেলেকে কলেজের সভাপতি করেন। এভাবে দুই উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল নিজের পছন্দের লোকজন।

এছাড়া খাস পুকুর ইজারা, টিআর কাবিখাসহ বিভিন্ন রকম উন্নয়নমূলক প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। ফলে এক মেয়াদে মাত্র পাঁচ বছর এমপির দায়িত্ব পেয়েই তিনি কয়েক’শ কোটি টাকার মালিক হন। অবৈধ এসব টাকা রাখার জন্য নিজের বাড়িতে দেওয়ালের সঙ্গে সিন্দুক বানিয়েছিলেন। এ ছাড়া বিদেশেও টাকা পাচার করার অভিযোগ রয়েছে ডা. মুনসুরের বিরুদ্ধে।

নিয়োগ-বাণিজ্য, অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ডা. মনসুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। দুদক সূত্রে জানা যায়, মনসুর রহমানের নির্বাচনী হলফনামা অনুসারে বার্ষিক আয় বেড়েছে সাড়ে ছয় গুণেরও বেশি। অন্যান্য সম্পদের পরিমাণও ২০০ গুণ বেড়েছে। শিক্ষকতা, শেয়ার ও চাকরি থেকে বার্ষিক আয় দেখালেও সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে অভিযোগ আছে। ফলে গত ২৭ আগস্ট মনসুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

অপরদিকে সদ্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা গেছে, আব্দুল ওয়াদুদ দারার বাবা আওয়াল ছিলেন একজন বিয়ে রেজিস্ট্রার কাজী। রাজশাহী পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ এলাকায় ছোট্ট মাটির ঘরে ছিলো পরিবার নিয়ে উনার বসবাস। কিন্তু এমপি থাকাকালে ১০ বছরে সেই মাটির ভাঙা বাড়ির স্থলে পাশাপাশি তিন ভাইয়ের জন্য তিনটি দোতলা বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেছেন দারা। মেয়েকে যুক্তরাজ্যে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছেন।

নির্বাচনী হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮ সালে প্রথমবার এমপি হওয়ার আগে দারা ও তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ছিল ৯২ লাখ ৪৫ হাজার টাকার। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৭২ লাখ টাকায়। এ ক্ষেত্রে টনিক হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষা-বাণিজ্য। তার প্রথম দুই মেয়াদে পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০০ জন নিয়োগ হয়। এর মধ্যে পুঠিয়ায় বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদে ২১৭ জন, কলেজের প্রভাষক পদে ১৮৭ জন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী কাম পিয়ন পদে ৩১ জনের নিয়োগ হয়েছে। দুর্গাপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয়েছে ২০৮ জনের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রত্যেক চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে দারার বিরুদ্ধে।

তার চাচা বিড়ালদহ বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আলীউজ্জামান মুন্টু ছিলেন শিক্ষা-বাণিজ্যের প্রধান। দুই উপজেলা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নেওয়ার জন্য দারার বাড়িতে আসা চাকরিপ্রত্যাশীদের সঙ্গে টাকার চুক্তি করতেন মুন্টু। তখন মুন্টুর উপাধি ছিল ‘শিক্ষামন্ত্রী’। মুন্টু ছাড়া আরও কয়েকজন শিক্ষা-বাণিজ্যের চুক্তি করতেন। তারা হলেন, পুঠিয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং সাবেক মেয়র রবিউল ইসলাম রবি, ধোপাপাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান মুন্টু।

অপরদিকে দারার চাচাতো ভাই শরীফ কাজী নিয়ন্ত্রণ করতেন দুই উপজেলার পল্লী বিদ্যুৎ বিষয়ের বাণিজ্য। কোনো এলাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগে লেনদেন দেখভালের দায়িত্ব ছিল তার। এ ছাড়া দারার আরেক চাচাতো ভাই রিপন টানা ১০ বছর উপজেলা পর্যায়ের সব টেন্ডার নিয়ে নিজে কাজ করতেন। শুধু তা-ই নয়, সরকারি পুকুর ইজারা ও কৃষিজমি ধ্বংস করে অবৈধভাবে পুকুর খনন, বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশন আদায় ছিল দারার আয়ের আরেকটি বড় উৎস। আবার, দারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নাটোর জেলায় বিদ্যুতের কুটল্যান্ড প্যানেলসহ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ফলে নিজের নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়ন না হলেও উন্নতি হয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের।

দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আইনজীবী কবিরুল ইসলাম সূর্যের করা লিখিত অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে, এমপি মনসুর রহমান বিগত পাঁচ বছরে এলাকার উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকার কমিশন-বাণিজ্য করেছেন। ওএমএস, সার ডিলার নিয়োগ, কাবিখা-কাবিটার টাকায় কমিশন নিয়েছেন। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় নিয়োগ-বাণিজ্য, এমপিও করে দেওয়ার নামে অর্থ-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য ও খাসপুকুরের ইজারা দেওয়াসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে সাবেক দুই এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারা ও মনসুর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর থেকে তারা পলাতক রয়েছেন। যার কারণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।

এসএস

Link copied!