রেহাই পাননি নিজ দলের নেতাকর্মীরাও

টুকু-রঞ্জনের দখল বাণিজ্যে অতিষ্ট পাবনার মানুষ

  • পাবনা প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ৭, ২০২৪, ০৬:১০ পিএম
টুকু-রঞ্জনের দখল বাণিজ্যে অতিষ্ট পাবনার মানুষ

শামসুল হক টুকু ও তার ছেলে আসিফ শামস রঞ্জন

পাবনা: জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পীকার ও পাবনা-১ আসনের সাবেক সাংসদ শামসুল হক টুকু এবং তার ছেলে বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আসিফ শামস রঞ্জনের বিরুদ্ধে দখল বাণিজ্যের নানা অভিযোগ উঠেছে। এত বছর তাদের ক্ষমতার দাপটে অতিষ্ট হয়ে চুপ থাকলেও, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগীরা।

নৌ-বন্দর দখল, হুরাসাগর নদী ও আশপাশে শতাধিক বিঘা জমি দখল, নদী থেকে কোটি কোটি টাকার বালু বাণিজ্য, মামলা দিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের হয়রানী সহ নানা অভিযোগ বেরিয়ে আসছে বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে। পাবনা-১ আসনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন টুকু ও তার ছেলে রঞ্জন। তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি নিজদলের নেতাকর্মীরাও।

দলীয় নেতাকর্মী ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেড়া পৌর সদরের বৃশালিখা মহল্লায় মাত্র ১০ বছর আগেও যেখানে ছিল আধাপাকা টিনের বাড়ি, সেখানে ২০০৮ সালের পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি করেন টুকু। দামি কাঠ, মূল্যবান টাইলস, বিলাসবহুল আসবাবপত্রে ঠাঁসা সেই বাড়িটি যেন এক রাজপ্রাসাদ। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সেই বাড়িটি পরিণত হয়েছে পোড়া এক অট্টালিকায়।

মন্ত্রী হওয়ার পর টুকুর সম্পদ বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে।  নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে ক্রয় করেন জমি, বাড়ি আর গাড়ি। ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ১৬১ কোটি টাকা অবৈধ আয়ের প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে দুদকের সেই মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়। এমনকি ফাইলও গায়েব হয়ে গেছে।

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টুকু তার বড় ছেলে আসিফ সামস রঞ্জনকে বানিয়েছিলেন বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বেড়া পৌরসভার মেয়র। আসিফ শামস রঞ্জনের ছিল ভিওআইপি ব্যবসা। উক্ত ব্যবসায় প্রায় ১৯২ কোটি টাকা কর ফাঁকির মামলা হয় দুদকে। সেই মামলায় সম্প্রতি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারী হলেও, ক্ষমতার দাপটে সেটি গোপন করে রেখেছিলেন তিনি। পরে সেটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে জামিন নেন রঞ্জন।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে ও স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা যায়, গত ৫ আগস্টের আগে শামসুল হক টুকু তার বাড়ির সামনে ইছামতী নদী দখল করে বালি দিয়ে ভরাট করে সুইমিংপুল বানানোর কাজ করছিলেন। তিনি অবৈধভাবে জোরপূর্বক দখল নিয়েছিলেন বেড়া বৃশালিখা কোল ঘাট (নৌ-বন্দর)। বেড়ার হুড়াসাগর নদী ও তার আশপাশের প্রায় এক’শ একর জমি দখল করেছেন। সেখানে গড়ে তুলেছিলেন নিজের প্রয়াত স্ত্রীর নামে লুৎফর নেসা ট্রাষ্ট। এছাড়া নদী থেকে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি করতেন টুকুর ছেলে রঞ্জন। আর হুড়াসাগর নদীর পাশে অনেক কৃষকের প্রায় একশ’ বিঘা জমি দখল করে সেখানে বালুর পাহাড় গড়ে তুলেছেন টুকু ও তার পরিবার। যার চিহ্ন এখনও দেখা গেছে।

বেড়া পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এনামুল হক শামিম বলেন, ‘হুরাসাগর নদীর পাড়ে আমার প্রায় ২০ লাখ টাকার বালুর খামাল ছিল। সেটা জোর করে দখলে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন টুকু ও তার ছেলে। প্রতিবাদ করায় মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং পুলিশ দিয়ে হয়রানী করে বাড়ি ছাড়া করেছে আমাকে। আমি টুকু ও তার ছেলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

মেসার্স বেড়া ট্রান্সপোর্টের স্বত্তাধিকারী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার নামে ইজারা পাওয়া বৃশালিখা কোল ঘাট (নৌ-বন্দর) জোর করে দখল নিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন শামসুল হক টুকু। ক্ষমতার দাপটে বৃশালিখা নৌ-বন্দরে আমার অফিস ভাংচুর, লুটপাট করেছিলেন টুকু ও তার ছেলে রঞ্জনের সন্ত্রাসী বাহিনী। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট এই ঘাট আবার আমি ফেরত পাই। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। তাই আমিও কিছু করতে পারিনি।’

সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর গ্রামের বাসিন্দা কালিপদ হালদার বলেন, ‘এখানে একটি সরকারি মৎস্য খামার রয়েছে। যেটি আমি সরকারিভাবে লিজ নিয়ে মাছ চাষ করতাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে টুকুর ছেলে রঞ্জন আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক হুমকি ধামকি দিয়ে খামারটি দখল করে নেয়। আমি হিন্দু মানুষ, তাদের সাথে কি পারি। তাই ছেড়ে চলে আসছি। রঞ্জন ওই মৎস্য খামারে গরুর খামার বানিয়েছিলেন।’

বেড়া পৌর এলাকার বাসিন্দা ও বেড়া পৌর আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুল মান্নান মানু বলেন, ‘নির্বাচন আসলেই টুকুর পছন্দের লোক দাঁড়াবে, তাকে জেতাতে হবে এটাই ছিল নিয়ম। নিজ দলের নেতাকর্মীরাও তার হাত থেকে রেহাই পাননি। যেমন গত জাতীয় নির্বাচনে আমি টুকুর বিরুদ্ধে অন্য প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাংচুর চালিয়েছে। বোমা হামলার মতো মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করেছে।’

বেড়া উপজেলার পায়না গ্রামের বাসিন্দা ও পৌর ছাত্রদলেন যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলের একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের বাড়িতে হামলা করে টুকু ও রঞ্জনের সন্ত্রাসী বাহিনী। তারা আমার বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করে। অপরাধ হলো আমি বিএনপি করি। পরে মামলা করতে গেলে তাদের দাপটে পুলিশ আমাদের এজাহার নেয়নি। তাদের ইচ্ছামতো সাজানো এজাহার তৈরি করেছে। আবার আদালতেও তাদের পছন্দমতো চার্জশিট দিয়েছে। ওই ঘটনায় কোনো আসামি আজও গ্রেপ্তার হয়নি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকের অভিযোগ, এসব অপকর্ম করেই টুকু ও তার ছেলে রঞ্জন হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। গ্রামে, পাবনা শহরে, ঢাকায় এমনকি বিদেশেও বাড়ি-ব্যবসা গড়েছেন পিতা-পুত্র। এখন সময় এসেছে তাদের সকল দুর্নীতির বিচার করার। তাই বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

পট পরিবর্তনের পর সাবেক ডেপুটি স্পীকার শামসুল হক টুকু গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকায় এবং তার ছেলে আসিফ শামস রঞ্জন পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে।

এসএস

সোনালী বিশেষ বিভাগের সাম্প্রতিক খবর

Link copied!