পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম

প্রভাবশালীদের চাপে সরাতে পারছে না প্রশাসন, ক্ষোভ বাড়ছে এলাকায়

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৫, ০২:২৪ পিএম
প্রভাবশালীদের চাপে সরাতে পারছে না প্রশাসন, ক্ষোভ বাড়ছে এলাকায়

ঢাকা : তদন্ত প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন এবং তদবির করেও পুরান ঢাকা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক গুদাম সরানো যাচ্ছে না। প্রভাবশালীদের চাপের কাছে কুলিয়ে উঠতে পারছে না প্রশাসন। উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছে।

গত ১৪ বছরে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সুপারিশ আসে কমিটির কাছ থেকে। কিন্তু সুপারিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে সবকিছু।

আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০১৯ সালের এই দিনে আগুনে নারী-শিশুসহ ৭১ জনের প্রাণহানি হয়। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ভয়াবহ আগুনে ১১৭ জন মারা যায়। এত মৃত্যুর ঘটনায় দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ওইসব বাড়ি ছিল কেমিক্যালে ঠাসা। এ ঘটনায় মামলা হলেও আসামিরা আছে বহাল তবিয়তে। নিমতলীর ঘটনাও এক কোনো গ্রেপ্তার নেই। ঝুঁকির মধ্যে আছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে লোকজনের মধ্যে।

রাসায়নিক কারখানাগুলো সরাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিক বিশেষ বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, কিছু রাজনীতিকের আশকারায় কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের পুরান ঢাকা থেকে সরানো যাচ্ছে না। কিছু ব্যবসায়ীকে কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত করা হলেও তারা গোপনে আবার আগের স্থানে ফিরে এসেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ নিয়ে বৈঠক হয়নি। এলাকাবাসীর আশা, অন্তর্বর্তী সরকার কারখানাগুলো সরানোর উদ্যোগ নেবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জে ২০ একর জায়গায় রাসায়নিক পল্লী স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু অল্পকিছু জায়গায় নামকাওয়াস্তে কেমিক্যাল কারখানা সরানো হলেও বেশিদিন টেকেনি। এসব স্থান নির্ধারণ নিয়ে নয়ছয়ের ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কারণে গুদাম সরানো যাচ্ছে না।

আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর, চানখাঁরপুলসহ আশপাশের এলাকার আবাসিক ভবনে গড়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ গুদামগুলো। এসব গুদাম ও কারখানার অধিকাংশেরই বৈধ কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নেই। তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো কার্যকর করাও সম্ভব হয়নি।

ইসলামবাগেই আছে ছোট-বড় কয়েকশ কেমিক্যাল, পলিথিন ও প্লাস্টিক তৈরির কারখানা। ভবনের মালিকরা বেশি ভাড়া পাওয়ার লোভে বাসার পরিবর্তে গুদাম বা কারখানা হিসেবে ভাড়া দিচ্ছেন। অনেক স্থানে ভবন জুড়েই রয়েছে গুদাম। যেসব কারখানা সরাতে হবে, তার একটি তালিকাও করা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির নির্দেশ উপেক্ষা করে বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

অভিযোগ উঠেছে, কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক নেতাদের বলয়ে থাকার কারণে তাদের সরানো যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতাও। চুড়িহাট্টা ও নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সিটি করপোরেশন, শিল্প মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। কেমিক্যাল কারখানার তালিকা গত সরকারের মন্ত্রিসভায়ও জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানান্তর কার্যক্রম আলোর মুখ দেখেনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গোডাউনকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের মতো গোডাউন অবৈধ। এসব গোডাউনে ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে।

গত শনিবার সকালে চকবাজার ও লালবাগ এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আগের মতোই ব্যবসা চলছে আনাচে-কানাচে। দেদার ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ীরা। পুরান ঢাকায় ছোট-বড় মিলে ২ হাজার ১৬৭টি রাসায়নিক কারখানা আছে। গোপনে ব্যাঙের ছাতার মতো কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের কারখানা চালানো, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গুদাম করা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বৈধভাবে এ ধরনের ব্যবসা করতে গেলে সরকারের একাধিক সংস্থার অনুমোদন বাধ্যতামূলক।

ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, স্থানীয় থানা, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ কমপক্ষে ছোট-বড় অন্তত ৯টি সরকারি দপ্তরের অনুমোদন নিতেই হয়। বৈধভাবে ওইসব দপ্তর থেকে ছাড়পত্র নেওয়াও কঠিন। সরকারের নিয়মনীতি মেনে আবাসিক এলাকায় এ ধরনের ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পুরান ঢাকায় যুগ যুগ ধরে চলছে বিপজ্জনক এই ব্যবসা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে দিব্যি রাসায়নিকের ব্যবসা চালানো হচ্ছে। কখনো তাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। কাউকে জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার লোকজনকে ম্যানেজ করেই চালানো হচ্ছে কারবার। বহুতল ভবনের নিচতলায় বিশাল গুদাম আর ওপরে মানুষের বসবাস দিব্যি চলছে।

নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা ঝুঁকির মধ্যে আছি। এতগুলো ঘটনার পর রাসায়নিক কারখানাগুলো সরানো হলো না। আমরা মর্মাহত। রাজনৈতিক নেতাদের কারণে এসব সরেনি। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার পরও গোডাউনগুলো সরছে না। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত বসবাসের স্থান থেকে এগুলো সরাবে।’

ওই ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, ‘২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেওয়ার জোর দাবি ওঠে। একটি দুর্ঘটনার রেশ না কাটতেই ঘটছে আরেকটি দুর্ঘটনা।’

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পুরান ঢাকা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে আবার ছোট-বড় কয়েকশ কেমিক্যাল কারখানা আছে। কোনো নিয়ম মানা হয় না। বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করব নতুন করে।’

রাসায়নিক কারখানাগুলোর মালিকরা বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালাচ্ছেন। কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের কথা থাকলেও তারা কর্ণপাত করছেন না। এলাকায় বেশিরভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্তরাই থাকেন, যে কারণে কারখানা-বাসা মিলিয়েই থাকেন। আগুন যদি বড় হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতিটা বেশি হবে।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর

এমটিআই

Link copied!