পদোন্নতি পাওয়া ৭ সচিবের ৪ জনই ফ্যাসিস্ট দোসর! 

  • নিজস্ব প্রতিবেদক:  | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২৫, ০৯:০২ পিএম
পদোন্নতি পাওয়া ৭ সচিবের ৪ জনই ফ্যাসিস্ট দোসর! 

ঢাকা: সম্প্রতি অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার ৭ কমকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এছাড়াও একজন সচিবের দফতর বদল এবং ওএসডি হওয়া এক সচিবকে পূর্নবহাল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এসকল সচিব পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী শাসনামলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠছে। নতুন পদোন্নতি পাওয়া ৭ সচিবের মধ্যে বঞ্চিত কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র ৩ জন। বাকী ৪ জনই স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের আমলে নিয়মিত পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণপদে পদায়ন হওয়া সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। যদিও হাসিনার শাসনামলে নির্যাতিত ও বঞ্চিত ছিলেন সচিব হওয়ার যোগ্য এমন শতাধিক কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মিজ আলেয়া আক্তার, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. কামাল উদ্দিন, বিআরটিসির চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) মো. তাজুল ইসলাম, যৌথমুলধন কোম্পানি ও ফার্মসমুহের নিবন্ধকের কার্যালয়ের নিবন্ধক মো. মিজানুর রহমান, ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্র্যানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মিজ জাহেদা পারভীন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুর রহমান।

এসকল কর্মকর্তার পিডিএস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নতুন সচিব পদোন্নতি পাওয়া সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামাল উদ্দিন শেখ হাসিনার আস্থাভাজন না হওয়ায় দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। প্রশাসন ক্যাডারের বিসিএস ১১ ব্যাচের মেধাবী ও সজ্জন এই কর্মকর্তাকে শেখ হাসিনার শাসনামলের ১৫ বছরে কোন পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অর্ন্তবর্তী সরকার তাকে ভূতাপেক্ষা উপসচিব, যুগ্নসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেন। এরপর দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হলো। 

পদোন্নতি তালিকার দুই নম্বরে থাকা পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব নিয়োগ পাওয়া মিজ আলেয়া আক্তার বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১০ম ব্যাচের কর্মকর্তা। শেখ হাসিনার আমলে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেলেও এই কর্মকর্তা যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতিতে কয়েকবার বঞ্চিত হন।

একই ব্যাচের কর্মকর্তারা ২০১৫ সালে যুগ্মসচিব এবং ২০১৮ সালে অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি পেলেও তিনি কয়েকবার বঞ্চিত হয়ে যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি পেয়েছেন যথাক্রমে ২০২০ ও ২০২৪ সালে।

পদোন্নতি তালিকার তিন নম্বরে রয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১১ ব্যাচের কর্মকর্তা মো: তাজুল ইসলাম। আওয়ামী শাসনামলে নিয়মিত ব্যাচের সাথে ২০১০ এ উপসচিব, ২০১৬ এ যুগ্মসচিব এবং ২০১৯ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। আওয়ামীলীগের আস্থাভাজন হওয়ায় গ্রেড-১ পদোন্নতিও পান এই কর্মকর্তা। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাত ধরে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সেখানে পাঁচ বছর কাজ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিপুল সংখ্যক পদে নিয়োগ দেন। আগামী ২২ মার্চ এই কর্মকর্তা পিআরএল এ যাবেন। মাত্র এক মাসের নীচে চাকরি থাকার কারণে বর্তমান প্রাকটিস অনুযায়ী তার সচিব পদোন্নতি পাওয়ার কথা নয়। তার পরেও এই কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

পদোন্নতি তালিকার ৪ নম্বরে রয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা মো: মিজানুর রহমান। আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় এই কর্মকর্তা নিয়মিত ব্যাচের সাথে ২০১২ সালে উপসচিব, ২০১৮ সালে যুগ্মসচিব এবং ২০২২ সালে অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি পেয়েছেন। আওয়ামীলীগের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ট হওয়ায় গত বছরের ১১ জানুয়ারী তাকে যৌথমুলধন কোম্পানি ও ফার্মসমুহের নিবন্ধকের কার্যালয়ের নিবন্ধক হিসেবে পদায়ন করা হয়। নামে বেনামে শত শত ভূয়া কোম্পানি গঠনের জন্যই তাকে ঐ পদে পদায়ন করা হয় বলে অভিযোগ উঠছে। 

তালিকার ৫ নম্বরে থাকা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৩ তম ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুর রউফ। এই কর্মকর্তা ২০১৫ সালে উপসচিব, ২০২০ সালে যুগ্মসচিব পরবর্তীতে অর্ন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান।

পদোন্নতি তালিকায় ৬ নম্বরে থাকা মিজ জাহেদা পারভীন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এই কর্মকর্তা চাকুরী জীবনে কখনো পদোন্নতি বঞ্চিত হননি। ২০১২ সালে উপসচিব, ২০১৮ সালে যুগ্মসচিব এবং ২০২২ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। গত ১৫ বছরের ১০ বছরই পদায়ন ছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। এরপর দুই বছর ছিলেন মন্ত্রপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। তার স্বামীও আওয়ামীলীগের আরেক আস্থাভাজন কর্মকর্তা এএইচএম সফিকুজ্জামান।

২০২২ সালের শেখ মুজিবুরের মৃত্যু বার্ষিকীতে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বই প্রকাশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বইটি সম্পাদনা করেন এই কর্মকর্তা। সম্পাদনার পাশাপাশি ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনীতি ভাবনা’ শীর্ষক প্রবন্ধও লেখেন এএইচএম সফিকুজ্জামান। এর পরেও তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করে অন্তবর্তী সরকার। 

আওয়ামলীগের আস্থাভাজন এই জুটির পদোন্নতি নিয়ে প্রশাসনে আলোচনার ঝড় বইছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন। উপ-সচিব, ও যুগ্ম সচিব, হওয়ার পরে দল বেঁধে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করেছেন উৎসমুখর পরিবেশে। শফিকুজ্জামান ইতিপূর্বে সচিব হওয়ার আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৯ বছর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৫ বছর এক নাগাড়ে চাকরি করেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পরিচিত ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় যখন ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী দিয়ে সারা ঢাকা শহরে ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছিল সেই সময়ে ৩০ জুলাই ২০২৪ এ মিজ জাহেদা পারভীন তার বাসায় স্বামী-স্ত্রী মিলে এবং জাহেদা তার ব্যাচমেটদের নিয়ে মহা উৎসবে মেতে ছিলেন। ৩০ তারিখ এর পর দিন ফেসবুকে এই ছবি শোভা পাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ ৫ আগস্টের পর সেই ছবি ফেসবুক থেকে উধাও হয়ে যায়। এরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আওয়ামী রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট।

পদোন্নতি তালিকায় ৭ নম্বরে থাকা মাহবুবুর রহমান বিসিএস শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে ১৩তম ব্যাচে যোগদান করেন। এরপর ২০১০ সালে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০২২ সালে। অর্থনৈতিক সর্ম্পক বিভাগ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে কাজ করেছেন।

একই দিনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রজ্ঞাপনে ওএসডি হওয়া সচিব পদমর্যাদার ১ জন কর্মকর্তাকে পুনরায় পদায়ন করা হয়। বদলি করা হয় আরেক সচিবকে। 

ওএসডি থেকে পুনরায় পদায়ন হওয়া মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব) এই কর্মকর্তাকে ওএসডি করে অর্ন্তবর্তী সরকার। বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালে শেখ হাসিনার লুটপাটের ৩০ কোটি টাকা গোপনে অনুমোদন করায় তাকে ওএসডি করা হয়েছিল বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। 

শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট এই কর্মকর্তা গত ১৫ বছর নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রউফের শিষ্য হিসেবে পরিচিত এই কর্মকর্তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন ছিলেন ১১ বছর।

একই প্রজ্ঞাপনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয় ও সংস্কার) মো: মাহমুদুল হোসাইন খানকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) হিসেবে বদলি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ায় ২০১৬ সালে এই কর্মকর্তাকে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের।

এসআই/আইএ

Link copied!