অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, শ্রেষ্ঠত্বের তাড়না আছে

  • ক্রীড়া ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২৩, ১২:২৬ পিএম
অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, শ্রেষ্ঠত্বের তাড়না আছে

ঢাকা : প্যাট কামিন্সের হাতে ট্রফি তুলে দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ট্রফি নিয়ে তখন একা দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। সতীর্থদের অপেক্ষা করছিলেন তিনি। কিন্তু মোদী তখন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কামিন্স যেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কী করবেন! একটু পর অবশ্য সতীর্থদের নিয়ে তিনি মেতে উঠলেন বিজয় উল্লাসে।

তার নেতৃত্বের অধ্যায়ের সাম্প্রতিক চিত্রই যেন ফুটে উঠল এই কয়েক মুহূর্তে। তার অধিনায়কত্ব নিয়ে কত সংশয় ছিল কত জনের! তিনি নিজেও ছিলেন খানিকটা ইতস্তত। কিছুদিন আগেই বলেছেন, নিজের ওয়ানডে অধিনায়কত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন।

সেই তিনিই এখন অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক!

এবং একটা জায়গায় তিনিই প্রথম। টেস্ট ও ওয়ানডের দুই বিশ্ব আসর, আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও  ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক আর কেউ নেই।

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ যদিও মাত্রই শুরু হয়েছে। স্রেফ দুটি আসরই হয়েছে। তবু প্রথমের কৃতিত্ব তো কামিন্সকে দিতেই হবে। তাছাড়া, ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হবেন তিনি, এই বিশ্বাসই বা কজনের ছিল!

তিনি সহজাত অধিনায়ক কি না, এটা নিয়েই অনেক প্রশ্ন ছিল। এমনিতেও ফাস্ট বোলাররা আদর্শক অধিনায়ক নন বলে একটা ধারণা তো যুগ যুগ ধরেই আছে ক্রিকেটে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে তো একজনও ছিলেন না এরকম। কামিন্সই প্রথম বিশেষজ্ঞ ফাস্ট বোলার, যিনি নিয়মিত অধিনায়ক হয়েছেন।

এছাড়া অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়করা সাধারণত যেমন ডাকাবুকো চরিত্র হয়ে থাকেন, তিনি ফাস্ট বোলারও হয়েও ঠিক তেমন নন। চিরকালীন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কদের চরিত্রে তাকে মনে হচ্ছিল বেজায় বেমানান।

টেস্ট অধিনায়কের দায়িত্ব তিনি তবু মোটামুটি ভালোভাবেই সামলাচ্ছিলেন ২০২১ সাল থেকে। ওয়ানডের অধিনায়কত্ব পাওয়াই ছিল বিস্ময়কর। প্রথমত, টেস্টে এমনিতেই তাকে অনেক ধকল নিতে হয়। দ্বিতীয়ত, ওয়ানডেতে বোলার হিসেবেও তার পারফরম্যান্স ঠিক মসৃণ বা ধারাবাহিক নন। ওয়ানডে ক্রিকেটের সঙ্গে তার ভালোবাসা ঠিক জমছিল না।

সেই কামিন্সকে অনেকটা বাধ্য হয়েই ওয়ানডের নেতৃত্ব দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। আগের অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ যখন ওয়ানডেকে বিদায় বললেন, বিশ্বকাপের বাকি তখন মোটে এক বছর। এই সময়ে আর নতুন কাউকে অধিনায়ক করার ঝুঁকি নেওয়া নেননি অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকরা। টেস্ট অধিনায়কের কাঁধেই বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয় কিছুটা নির্ভরতা নিয়ে, কিছুটা আশা নিয়ে।

ওয়ানডের নেতৃত্ব পাওয়ার পরপর পরবর্তী এক বছরের করণীয় ঠিক করেছিলেন কামিন্স। অ্যাশেজের বছর, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের বছর, আর বিশ্বকাপের বছরে চোখ রেখে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন আইপিএলের লোভনীয় হাতছানি থেকে।

সেই ত্যাগের প্রতিদান তিনি পেতে শুরু করেন। জুনে ওভালে ভারতকে হারিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়শিপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন। ইংল্যান্ডের ‘বাজবলের’ চ্যালেঞ্জের জবাব দিয়ে অ্যাশেজ ধরে রাখায় নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ওয়ানডের সুর ঠিক ধরতে পারছিলেন না।

গত বছরের অক্টোবরে তাকে ওয়ানডে অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই সংস্করণে তার নেতৃত্ব পরখ করে দেখার সুযোগই তো হচ্ছিল না। চোট-বিশ্রাম-বিরতি মিলিয়ে ওয়ানডে খেলতেই পারছিলেন না তিনি।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, বিশ্বকাপ খেলতে যখন ভারতে দল নিয়ে আসেন তিনি, তখন স্রেফ দুটি ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব করার অভিজ্ঞতা ছিল তার সঙ্গী। সেই দুটি ম্যাচও ছিল গত বছরের নভেম্বরে!

এমনকি বিশ্বকাপের ঠিক আগে ভারতে যে তিন ম্যাচের সিরিজ, সেখানেও তিনি প্রথম ম্যাচ খেলতে পারেননি। শেষ দুই ম্যাচে অবশ্য খেলেন এবং দলকে নেতৃত্ব দেন। সব মিলিয়ে চার ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব করার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি শুরু করেন বিশ্বকাপ অভিযান।

সেই ১৯৭৯ সালে একদম আনকোরা অধিনায়ক কিম হিউজের নেতৃত্বে খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া। এরপর আর কোনো বিশ্বকাপে এতটা অনভিজ্ঞ অধিনায়ক ছিল না তাদের। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে পেশাদারিত্ব এতটা প্রবল, পরিকল্পনা এতটা দীর্ঘমেয়াদি ও সুনিপুন যে, এরকম হওয়ার সুযোগই থাকে না। কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিকতা মিলিয়ে কামিন্স ব্যতিক্রম।

এখন তাকে বলা যায় উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

কিন্তু ছয় সপ্তাহ আগের চিত্র ছিল ভিন্ন। প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে স্রেফ বিধ্বস্ত হয় তারা। টানা দুই ম্যাচে হারের ধাক্কা তো ছিলই। দলের নানা ঘাটতি-দুর্বলতাও তখন প্রকাশ্য হতে থাকে। পেসারদের ধার নেই, অ্যাডাম জ্যাম্পা ছাড়া স্কোয়াডে কোনো বিশেষজ্ঞ স্পিনার নেই, অধিনায়কের নিজের পারফরম্যান্স নেই, ব্যাটসম্যানদের ছন্দ নেই… আরও কত কত!

তৃতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কা বিপক্ষেও তাদের শুরুটা ছিল যাচ্ছেতাই। ২১ ওভারে ১২৫ রানের জুটি গড়ে ফেলে শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার। কামিন্সের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার তাড়না মাথাচাড়া দিয়ে উঠে বুঝি তখনই। দুই ওপেনারকেই ফেরান তিনি। অধিনায়ককে দেখেই হয়তো উজ্জীবিত হয়ে ওঠে অন্যরাও। দারুণ শুরুর পরও বাজে ধসে গুটিয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। রান তাড়ায় নিখুঁত না হলেও স্বস্তির জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে অস্ট্রেলিয়া।

ব্যস, সেই শুরু।

একবার জয়ের স্বাদ পেলে, নিজেদের খুঁজে পেতে থাকলে অস্ট্রেলিয়াকে তো আটকানো কঠিন। বিশেষ করে সেটা যদি হয় বিশ্বকাপের মঞ্চ, সেখানে তো তাদেরই রাজত্ব। সেই অহমও প্রেরণা জোগায় তাদের, তাতিয়ে দেয়।

একের পর এক জয় ধরা দিতে থাকে। কামিন্সের নিজের পারফর‌ম্যান্স প্রত্যাশিত না হলেও দলে তার নেতৃত্বের প্রভাব কিছুটা হলেও স্পষ্ট হতে থাকে। টানা সাত জয়ে সেমি-ফাইনালে ওঠার পর কটিন পরীক্ষার দিনটিতে আরও পরিষ্কার হয় কামিন্সের নেতৃত্বে ছাপ। কলকাতায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দারুণভাবে দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি। বড় ম্যাচের জন্য দলকে তৈরি ও উজ্জীবিত করা, বোলিং পরিবর্তন থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল দারুণ। তিনি নিজে বোলিংয়ের শুরুটা ভালো না করলেও পরে ঘুরে দাঁড়িয়ে নেন ৩ উইকেট। পরে রান তাড়ায় রোমাঞ্চ ছড়িয়ে ম্যাচ জিতে ফাইনালে আসে অস্ট্রেলিয়া।

ফাইনালে ওঠা অধিনায়কের একটু হলেও তো কৃতিত্ব প্রাপ্য!

তা কামিন্স পাচ্ছিলেন। তবে তার সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল অধিনায়ক থেকে নেতা হয়ে ওঠার। একটা ‘লেগ্যাসি’ গড়ার।

ফাইনালে সবটুকুই করলেন কামিন্স।

টসের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু। টস জিতেছেন তিনি ভাগ্যের জোরে। তবে টস জিতে বোলিং নেওযার সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল তার ক্রিকেটীয় মেধা। উইকেট শুরুর ভাগে কিছুটা মন্থর থাকবে এবং পরের দিকে কৃত্রিম আলোয় ভালো হয়ে উঠবে, শিশির পড়ার পর ব্যাটিং সহজ হবে, এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। যদিও ভারতীয় দলের অধিনায়ক রোহিত শার্মা আগে ব্যাটিংই করতে চেয়েছিলেন। মানে, স্বাগতিক অধিনায়কের চেয়েও বেশি ভালোভাবে উইকেট ও কন্ডিশন পড়তে পেরেছিলেন কামিন্স ও তার দলের ম্যানেজমেন্ট।

এরপর বোলারদের তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, যেভাবে স্পেলগুলো করিয়েছেন, পেস-স্পিনের সমন্বয় যেভাবে আক্রমণে রেখেছে, বিশেষজ্ঞ পঞ্চম বোলারের ঘাটতি যেভাবে বুদ্ধিমত্তায় পুষিয়ে দিয়েছেন, প্রতিটি ব্যাটসম্যানের শক্তির জায়গা বুঝে বোলার অনুযায়ী যেভাবে মাঠ সাজিয়েছেন, সব কিছুই ছিল প্রায় নিখুঁত। ভিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুলের মতো দুজন ব্যাটসম্যান ক্রিজে থাকলেও টানা ১৬ ওভারে বাউন্ডারি আসেনি। এরপর আরেক দফায় রাহুল, রবীন্দ্র জাদেজা, সুরিয়াকুমার ইয়াদাভের সময় টানা ১২ ওভারে আসেনি বাউন্ডারি। ভাবা যায়!

অধিনায়ক হিসেবে কামিন্স ট্যাকটিক্যাল মাস্টারক্লাস মেলে ধরেছেন ফাইনালে।

ফাস্ট বোলিং অধিনায়করা সাধারণত খুব কুশলী ও কৌশলি হতে পারেন না বলে যে এত বছরের ধারণা, সেটিকেও যেন বুড়ো আঙুল দেখালেন তিনি।

বাকি ছিল তার নিজের বোলিং। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া। ফাইনালে সেখানেও তিনি লেটার মার্কস পেয়ে উতরে গেছেন। ট্রাভিস হেডের দুর্দান্ত ক্যাচে রোহিত আউট হওয়ার পর কামিন্সের অসাধারণ এক ডেলিভারিতেই শ্রেয়াস আইয়ার বিদায় নেন অল্পতে। পরে ফিফটি পেরিয়ে ভিরাট কোহলি যখন ঝড় তোলার অপেক্ষায়, তখন তাকেও বিদায় করেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। আপাত চোখে মনে হতে পারে, আলসে শটে বাইরের বল স্টাম্পে টেনে এনেছেন কোহলি। আদতে মন্থর উইকেটে বাড়তি যে বাউন্স কামিন্স আদায় করেছেন, বলটা বুক সমান উচ্চতায় তুলেছেন, সেই কৃতিত্ব তো তারই।

১ লাখ ৩২ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামে স্বাগতিক দলের সঙ্গে লড়াইয়ের সম্ভাব্য চাপ নিয়ে ফাইনালের আগের দিন তিনি বলেছিলেন, “বিশাল সংখ্যক দর্শককে চুপ করিয়ে দিতে পারার চেয়ে তৃপ্তিদায়ক কিছু খেলাধুলায় আর নেই। আগামীকাল (ফাইনালে) এটিই আমাদের লক্ষ্য। এটা বলতেও কলিজা লাগে, আত্মবিশ্বাস লাগে। সবচেয়ে বড় কথা, মাঠে করে দেখাতে সেই দক্ষতা ও মানসিকতা লাগে। কামিন্স প্রমান করলেন, তার ও তাদের তা আছে।

ফাইনালের সেরা যদিও ট্রাভিস হেড এবং তা উপযুক্তই, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার এই জয়ে তাদের অধিনায়কের প্রভাবও প্রবল, দলের নেতার ছাপ স্পষ্ট। এই জয়ের পরতে পরতে মিশে আছেন কামিন্স।

সেই কামিন্স, অধিনায়ক হিসেবে যাকে নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল খোদ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট মহলেই, যিনি নিজেও নেতৃত্বে অমর হওয়ার মতো কীর্তি কখনও গড়তে চাননি। ব্যস্ত ক্রিকেট সূচির এই সময়ে বিশ্বকাপের পর তিনি আদৌ ওয়ানডে অধিনায়ক থাকবেন কি না বা তাকে রাখা হবে কি না, এই সংশয়ও আছে। তবে যেটুকু সময়ই পেয়েছেন, তিনি বিজয়ের পথে ছুটতে চেয়েছেন, দলকে চূড়ায় নিতে চেয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের চিরায়ত গৌরবকে সমুন্নত রাখতে চেয়েছেন।

তিনি পেরেছেন। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক হয়ে উঠেছেন। সফল অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক হয়েছেন। এখন বলতেই হবে, কামিন্স পেরেছেন। সূত্র : বিডিনিউজ

এমটিআই

Link copied!