ঢাকা : ‘সম্ভবত না...’, ফাইনালে ওঠার ব্যাপারটি এখনও পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছেন কি না, জানতে চাওয়া হলে ছোট্ট করে বললেন এইডেন মার্করাম। আফগানিস্তানকে হারিয়ে সেমি-ফাইনালের বাধা পার করার তখনও ঘণ্টা পেরোয়নি। দেশের ক্রিকেটের বড় অর্জনের মাহাত্ম এত দ্রুত অনুধাবন করা হয়তো কঠিনই। তবে এখানেই তৃপ্ত হতে চান না প্রোটিয়া অধিনায়ক। প্রথমবার ফাইনালে উঠে শিরোপা জয়ের ছবি মনের মধ্যে আঁকতে শুরু করেছেন তিনি।
৭টি ভিন্ন বিশ্বকাপ, দীর্ঘ ৩২টি বছর, কয়েকটি ভিন্ন প্রজন্ম- বারবার কাছে গিয়েও ক্রিকেটের বিশ্ব আসরের ফাইনালে ওঠা হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার। কখনও অদ্ভুত বৃষ্টি আইন, কখনও নিজেদের ব্যাখ্যাতীত ভুল বা কখনও শেষ ওভারের নাটকীয়তা, প্রতিবার ফলাফল একটাই- সেরা চার থেকে প্রোটিয়াদের বিদায়।
সেই বাধা অবশেষে অতিক্রম করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছে এইডেন মার্করামের দল। অজেয় যাত্রায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে আফগানিস্তানকে গুঁড়িয়ে ফাইনালে নাম লিখিয়েছে তারা। এর আগে ওয়ানডের ৫টি ও টি-টোয়েন্টির দুটি আসরে সেমি-ফাইনালেই থেমেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার যাত্রা।
এতবার খুব কাছে গিয়ে সেমি-ফাইনালের বৈতরণী পার করতে না পারায় ‘চোকার’ তকমাও এঁটে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার নামের পাশে। আরও একটি সেরা চারের লড়াইয়ের আগেও অনেক আলোচনায় এসেছে এই প্রসঙ্গ। আবারও কি ‘চোক’ করবে দক্ষিণ আফ্রিকা?, সেই শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে।
ত্রিনিদাদের ব্রায়ান লারা ক্রিকেট একাডেমিতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় সকালে সব শঙ্কা ধুলোয় মিশিয়ে আফগানদের মাত্র ৫৬ রানে গুটিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। পরে রান তাড়ায় ৮.৫ ওভারে তারা পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
আগের কোনো দল যা করতে পারেনি, সেই ফাইনালের টিকেট অর্জনের পর পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অনুভূতি প্রকাশে ভীষণ কৃপণতা দেখান মার্করাম। পরে সংবাদ সম্মেলনেও উচ্ছ্বাসে ভাসলেন না প্রোটিয়া অধিনায়ক। বরং মনে করিয়ে দিলেন, ট্রফি ঘরে তুলতে আসল লড়াই এখনও বাকি।
“সম্ভবত না…! এখন আমাদের মনে যা খেলা করছে, অবশ্যই দারুণ অনুভূতি। সত্যিই ভালো অনুভূতি। সাদা বলের ক্রিকেটে দুই সংস্করণেই এই দলটি লম্বা সময় ধরে একসঙ্গে। আমাদের জন্য ফাইনালে ওঠা খুব ভালো ব্যাপার। আমরা বিশ্বাস করি যে, সেরাদের সঙ্গে লড়াই করতে পারি এবং ট্রফি জিততে পারি। ফাইনালে উঠে সেই সুযোগ তৈরি করতে পারা আমাদের জন্য দারুণ ব্যাপার।”
আগের প্রজন্ম সেমি-ফাইনাল থেকে খালি হাতে ফেরা দলগুলোর সারথিদের একজন ডেল স্টেইন। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ওভারে তার বলে ছক্কা মেরেই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন ধূলোয় মিশিয়ে দেন গ্র্যান্ট এলিয়ট।
১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে বল হাতে ৫ উইকেটের পর ব্যাটিংয়ে ২০ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন শন পোলক। অ্যালান ডোনাল্ড ও ল্যান্স ক্লুজনারের পাগলাটে রান আউটে ওই ম্যাচ টাই হওয়ার পর সুপার সিক্সের ফলের ভিত্তিতে বাদ পড়ে প্রোটিয়ারা।
স্টেইন, পোলক, ডোনাল্ডের মতোই সেমি-ফাইনাল থেকে খালি হাতে ফেরাদের তালিকায় আছেন গ্রায়েম স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্স, জ্যাক ক্যালিস, হানসি ক্রনিয়ের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক কিংবদন্তি।
দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ফাইনালের দেখা পাওয়ার মুহূর্তটি ধারাভাষ্য কক্ষে মাইক্রোফোন হাতে বর্ণনা করেন পোলক। তার কাছেই তখন বসা স্টেইন। পরে উত্তরসূরিদের সাফল্যে সামাজিক মাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন স্টেইন, স্মিথরা। আর পূর্বসূরিদের গর্বিত করতে পারায় তৃপ্ত মার্করাম।
“সত্যি বলতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে (স্টেইনের সঙ্গে) কথা হয়নি। তবে আমি মনে করি, তারা এই খেলাটির কিংবদন্তি, দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের কিংবদন্তি। তাই আমার চোখে, তারা ফাইনাল খেললেন কি খেললেন না, সেটি কোনো বিষয়ই না। কারণ তারা আমাদেরকে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।”
“তাদের কারণেই আমাদের আগে যারা খেলেছে তাদের সবারই প্রতিনিধিত্ব করছি। তাই তাদের গর্বিত করতে পেরে আমরা আনন্দিত। যদিও আমি মনে করি, এখনও একটি ধাপ বাকি আছে। তবে আপাতত ডেল স্টেইনের মতো একজনকে খুশি হতে দেখে আমি খুবই আনন্দিত।”
বড়দের ক্রিকেটে আগে যেহেতু কোনো দল ফাইনাল খেলেনি, তাই নিজ দেশ থেকে প্রেরণা নেওয়া সুযোগ নেই মার্করামের। তবে তার অধিনায়কত্বেই ২০১৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
দশ বছর আগের ওই টুর্নামেন্টের মতো এবারও এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচ হারেনি প্রোটিয়ারা। বিশ্বকাপে টানা ৮ জয়ের রেকর্ড ছুঁয়ে শিরোপার দুয়ারে গিয়ে ঠেকেছে তারা।
লম্বা সময় আগের কথা হলেও বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের ওই সাফল্য থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা কাজে লাগাতে চান মার্করাম।
“সত্যি বলতে সেটির (২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ) কথা চিন্তা করিনি। অনেক আগের কথা এবং আমার স্মৃতিশক্তি অত ভালো নয়। তবে হ্যাঁ, আপনি যখন জানেন যে, কোনো এক পর্যায়ে আগে এটি করেছেন, তখন কিছুটা আত্মবিশ্বাস পাওয়া যায়।”
“আমার মনে হয় না, দুটো পুরোপুরি এক। তবে ফাইনালে উঠলে একই ধরনের চাপ নিতে হয় এবং আমরা ২০১৪ সালে সেই অভিজ্ঞতা পেয়েছি। তাই কিছুটা আত্মবিশ্বাস সেখান থেকে নিতে পারি আমরা। যা সম্ভাব্য সেরা উপায়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।”
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ও চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মাঝে ভারতে গত বছরের ওয়ানডে বিশ্বকাপে টেম্বা বাভুমার অনুপস্থিতিতে দুটি ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দেন মার্করাম। ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের বিপক্ষে দুই ম্যাচেই জেতে দক্ষিণ আফ্রিকা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আইসিসি বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে ১৬ ম্যাচ ধরে অপরাজিত মার্করাম।
চলতি টুর্নামেন্টে অধিনায়ক হিসেবে সাফল্যের কৃতিত্ব পুরোটাই দলকে দেন মার্করাম। বিশেষ করে গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু বোলাররা যেভাবে নিয়মিত পারফর্ম করছে, তা আলাদাভাবে মনে করিয়ে দেন ২৯ বছর বয়সী টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান।
“শুধু আজকে নয়, পুরো টুর্নামেন্টে বোলাররা দারুণ করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানদের বাঁচিয়েও দিয়েছে তারা। কন্ডিশন আমি বলব তাদের পক্ষে ছিল। তবু নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করতে হতো। ঠিক এই জায়গায়ই জায়গা নিয়মিত ভালো করেছে। তাই তাদেরকে অনেক কৃতিত্ব দিতেই হবে।”
বারবাডোজে আগামী শনিবার হবে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ। ভারত ও ইংল্যান্ডের লড়াইয়ে জয়ী দলের বিপক্ষে খেলবে দক্ষিণ আফ্রিকা।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :