এই দিনটির জন্য ১৩ বছর অপেক্ষায় ছিলেন রদ্রিগেজ

  • ক্রীড়া ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১১, ২০২৪, ০৬:০৬ পিএম
এই দিনটির জন্য ১৩ বছর অপেক্ষায় ছিলেন রদ্রিগেজ

ঢাকা: কোপার সেমিফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে জেফারসন লেরমা কলম্বিয়ার জয়সূচক গোলটা করেছেন রদ্রিগেজের নেওয়া কর্নার কিক থেকে।

এই ‘অ্যাসিস্ট’ (গোল বানানো) রদ্রিগেজকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। কোপার এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোল বানিয়ে দেওয়ার রেকর্ডে লিওনেল মেসিকে ছাড়িয়ে গেছেন রদ্রিগেজ।

কলম্বিয়ান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার এবারের কোপায় গোল বানিয়েছেন ৬টি। ২০২১ কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনাকে শিরোপা জেতানোর পথে ৫টি গোল বানিয়েছিলেন মেসি। গোল বানিয়ে দেওয়ার এই কীর্তিতে রদ্রিগেজ ছুঁয়েছেন ফুটবলের ‘রাজা’ পেলেকেও। ১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের পর লাতিন আমেরিকার প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বড় কোনো টুর্নামেন্টে ৬টি গোল বানালেন রদ্রিগেজ।

অথচ এই রদ্রিগেজেরই সর্বশেষ কোপা আমেরিকার কলম্বিয়া দলে জায়গা হয়নি। ফিটনেস-ঘাটতিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাকে দল থেকে বাদ দিয়েছিলেন সেই সময়ের কোচ রেইনালদো রুয়েদা। গত কয়েক বছরে এ ক্লাব থেকে ও ক্লাব যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ানো এবং সর্বোপরি ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের পাট চুকানোয় কেউ কেউ হয়তো তার নান্দনিক ফুটবলশৈলীরও শেষ দেখে ফেলেছিলেন। 

কিন্তু দুঃসময় পেছনে ঠেলে কীভাবে ফিরে আসতে হয়, তা নিশ্চয়ই ভালো করেই জানা রদ্রিগেজের। ঘুরে দাঁড়ানোর ‘ডিএনএ’ তো রিয়াল মাদ্রিদে থাকতেই আত্মস্থ করেছেন। ৩২ বছর বয়সী এ ফুটবলার কিছুটা বুড়িয়ে গেলেও ফুরিয়ে যে যাননি, এবারের কোপা আমেরিকা যেন তার কাছে সেটিই প্রমাণের মঞ্চ। কলম্বিয়ার কোচ নেস্তর লোরেঞ্জো রদ্রিগেজের ওপর আস্থা রেখেছেন, ম্যাচের পর ম্যাচ পারফর্ম করে তিনি সেটারই প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন। অধিনায়ক হওয়ার পর দলকে একসূত্রে গেঁথেছেন। টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত থাকা কিংবা ২৩ বছর পর কোপার ফাইনালে ওঠা শক্তিশালী এই গাঁথুনিরই প্রতিফলন।

দারুণ দলীয় বোঝাপড়ার উদাহরণ হিসেবে আজকের ম্যাচটিই তো সামনে আনা যায়। দ্বিতীয়ার্ধে হলুদ দেখার ৭ মিনিট পরেই রদ্রিগেজকে তুলে নেন কোচ লোরেঞ্জো। যেহেতু কলম্বিয়া তখন এগিয়ে ছিল, তাই বাকিটা সময় তাকে খেলানোর ঝুঁকি নিতে চাননি কোচ। 

বলা তো যায় না, আচমকা আরেকটি হলুদ কার্ড দেখলেই দলের অধিনায়ককে ফাইনালে দর্শক হয়ে থাকতে হবে! মায়ামিতে মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইকে যে ‘ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ ম্যাচ মনে করছেন রদ্রিগেজ।

কলম্বিয়া জাতীয় দলের জার্সিটা ২০১১ সালে প্রথমবার গায়ে জড়ালেও ফুটবল-বিশ্ব রদ্রিগেজকে চিনেছিল ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ দিয়ে। ৬ গোল করে সেবার গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন রদ্রিগেজ। উরুগুয়েকে তার প্রিয় প্রতিপক্ষই বলতে পারেন। 

আজ উরুগুয়াইদের ধন্দে ফেলে দেওয়া রদ্রিগেজের কর্নার কিক থেকেই ব্যবধান গড়ে দিয়েছেন লেরমা। কোপার আগে সর্বশেষ গোল আর অ্যাসিস্টও করেছিলেন উরুগুয়ের বিপক্ষে, গত বছরের অক্টোবরে ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে।

তবে যে গোল তাকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছে, তা কারও ভোলার কথা নয়। ২০১৪ বিশ্বকাপের শেষ ষোলো পর্বে বক্সের বাইরে বুক দিয়ে রিসিভ করে ভলি বানিয়ে নেওয়া শটে করা গোলটা তো উরুগুয়েকে আসর থেকেই ছিটকে দিয়েছিল, কলম্বিয়াকেও নিয়ে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত এটিই দেশটির সর্বোচ্চ সাফল্য।  

রদ্রিগেজের সেই গোলের পরেই তাকে পেতে পরাশক্তিধর ক্লাবগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে পেয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। কোচ কার্লো আনচেলত্তির চাওয়াতেই মূলত রিয়ালে নাম লেখাতে পেরেছিলেন। লস ব্লাঙ্কোসদের হয়ে ছয় মৌসুমে জিতেছেন ৯টি শিরোপা। আনচেলত্তির সঙ্গে বরাবরই তিনি সুসম্পর্ক জিইয়ে রেখেছেন। মাঝে আনচেলত্তি বায়ার্ন মিউনিখে গেলে সেখানে তিনিও ধারে খেলতে যান। জার্মান ক্লাবটির হয়েও আছে ৩টি শিরোপা।

আনচেলত্তি এভারটনের কোচ হলে সেখানেও তাকে নিয়ে যান। তখন থেকে আর কোথাও সেভাবে থিতু হতে পারেননি। গত চার বছরে ক্লাব বদলেছেন চারবার। ইংলিশ ক্লাব এভারটন ছেড়ে যান কাতারি ক্লাব আল রাইয়ানে। এক মৌসুম পরেই ফিরে আসেন ইউরোপে। যোগ দেন গ্রিক ক্লাব অলিম্পিয়াকোসে। সেখান থেকে গত বছর নাম লেখান সাও পাওলোতে। ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাবটির হয়ে এরই মধ্যে একটি ট্রফিও জিতেছেন।

রদ্রিগেজের জীবনে অবশ্য খারাপ সময় আসে আরও আগেই, যেটা তার মাঠের পারফরম্যান্স ও ফিটনেসের ওপরও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। অন্য সব ফুটবলারের মতো রদ্রিগেজের জীবনও বুঝিয়ে দেয়, তিনি রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের জীবনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই জীবনে যে কত কিছু ঘটে যায়, সেই খোঁজ কজনই-বা রাখে!

রদ্রিগেজও জীবনের হিসাবটা ঠিক মেলাতে পারছিলেন না। ২০১০ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন কলম্বিয়ান সতীর্থ গোলকিপার দাভিদ ওসপিনার বোন ও ভলিবল খেলোয়াড় দানিয়েলা ওসপিনাকে। কলম্বিয়ান মিডিয়ায় সুখী ক্রীড়া দম্পতি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন রদ্রিগেজ ও দানিয়েলা। 

কিন্তু ২০১৭ সালে কিছু ভুল-বোঝাবুঝির কারণে ভেঙে যায় তাদের সংসার। এরপর থেকে সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে থাকতে শুরু করেন সাবেক স্ত্রী দানিয়েলা। স্ত্রী-সন্তান চলে যাওয়ায় এমনিতে একা হয়ে পড়েছিলেন, করোনাকালে লকডাউনে ঘরবন্দী জীবন তাকে আরও একা করে তোলে। সেই রদ্রিগেজ নিজেকে আবার নতুন করে ফিরে পেয়ে দেশের হয়ে কোপার ফাইনাল খেলতে যাচ্ছেন দানিয়েলার নতুন ঠিকানা মায়ামিতেই। নিয়তি কি একেই বলে!

দানিয়েলার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ায় ‘প্রতিশোধস্বরূপ’ একটা কাজ তো করতেই পারতেন রদ্রিগেজ। কোচের প্রথম পছন্দের গোলকিপার না হওয়ায় দানিয়েলার ভাই দাভিদ ওসপিনাকে চাইলে অধিনায়কত্বের প্রভাব খাটিয়ে অনায়াসে কোপার দল থেকে বাদ দিতেই পারতেন। কিন্তু রদ্রিগেজ তা করেননি। পেশাদারত্বের জায়গাটুকু ঠিক রেখে কলম্বিয়ার হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যাচ্ছেন, একসঙ্গে অনুশীলন করছেন, জাতীয় সংগীত গাইছেন।  

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে দানিয়েলা স্বীকার করেছেন, রদ্রিগেজের সঙ্গে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাজে ছিল। দুজন আবার এক হবেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে আপাতত রদ্রিগেজের প্রথম কাজ দানিয়েলার শহরে কলম্বিয়ার ২৩ বছরের শিরোপা-খরা ঘোচানো। বাংলাদেশ সময় সোমবার সকালে মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামার আগেই অবশ্য দারুণ এক উপলক্ষ ধরা দিতে চলেছে রদ্রিগেজের জীবনে। আগামীকাল তার ৩৩তম জন্মদিন!

অধিনায়কের জন্মদিনের আগের দিন কলম্বিয়া কোপার ফাইনালে উঠেছে। কেক কেটে, বেলুন ফাটিয়ে, পার্টি স্প্রে ছড়িয়ে কিংবা মুখে ক্রিম মাখিয়ে রদ্রিগেজের এবারের জন্মদিনটা হয়তো স্মরণীয়ই করে রাখবেন সতীর্থরা। কিন্তু রদ্রিগেজকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই সতীর্থদের কাছে আরও বড় উপহার চাইবেন। উপহারটা কী না বললেও চলত। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার ট্রফি উঁচিয়ে ধরা!

রদ্রিগেজ এই ট্রফিটা কতখানি চান, সেটাও ভেজা চোখে বুঝিয়ে দিয়েছেন ম্যাচ শেষে। ২০১১ সালে জাতীয় দলে তার অভিষেকের পর কলম্বিয়া দুবার কোপায় তৃতীয় হয়ে বিদায় নিয়েছে। 

এর পাশাপাশি কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেও বাদ পড়েছে। বিশ্বকাপেও কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা টপকে যেতে পারেনি। এবার দেশকে একটি বড় শিরোপা জেতাতে রদ্রিগেজ কতটা উন্মুখ, সেটি তার কথায় পরিষ্কার বোঝা গেল, ‘আমরা এখন স্বপ্নের ঘোরে আছি। এই মুহূর্তটির (ফাইনাল) জন্য ১৩ বছর অপেক্ষায় ছিলাম।’

এআর

Link copied!