ঢাকা : ফুলের মতো নিষ্পাপ, সুন্দর আর স্মাট ছোট্ট একটি শিশু। আট-দশটা শিশুর মতো হলেও আঁখি সবার চেয়ে আলাদা। তার চলা ফেরার মধ্যে রয়েছে একটা আভিজাত্য। কিন্তু সে এতোটাই হতোভাগা আর দুর্ভাগ্য যে বাবা-মা থাকার পরও তাদের আদর, যত্ব, ভালোবাসা তার কপালে জুটছে না। বর্তমানে তার আশ্রয় হয়েছে রাজধানীর আজিমপুর সরকারি ছোটমনি নিবাসে। ২ মাস ধরে এই নিবাসে থাকলেও প্রতিনিয়ত আঁখির মুখে একটাই বুলি ‘আম্মু যাবো, আম্মু যাবো’।
জানা গেছে, ময়মনসিংহের ত্রিশালের একটি পার্লারের সামনে আঁখিকে রেখে যায় তার মা। ‘মা’ শব্দটি মমতাময়ী হলেও আসলে তিনি একজন ‘পাষণ্ড মা’। পার্লারে কর্মরত এক নারী তাকে পেয়ে তার মাকে অনেক খোঁজা খুঁজি করেন। মাকে না পেয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে আঁখিকে। একটি জিডিও হয়। পার্লারের কর্মরত ওই নারীর কাছে তিন দিন থাকে ছোট্ট আঁখি। আঁখির একটাই কান্না ‘আম্মু যাবো, আম্মু যাবো’। তার কান্না দেখে পুলিশ সহৃদয় হয়ে আঁখির মাকে খুঁজতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ কিশোরগঞ্জ থেকে আঁখি মাকে খুজে বের করে। এরপর বাবাকেও খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বাবা-মা কেউ আঁখিকে নিতে রাজি হয়নি।
আরও জানা গেছে, আঁখির বাবা অন্য একটি বিয়ে করে সংসার করছেন। একই সাথে আঁখির মাও আরেকটি বিয়ে করে সংসার করছেন। তবে যাকে বিয়ে করেছেন তিনি খুবই গরিব হওয়ায় আঁখি লালন পালন করার মত তাদের সামর্থ্য নেই বলে জানায়। ফলে আঁখি শেষ আশ্রয় হিসেবে রাজধানীর আজিমপুর সরকারি ছোটমনি নিবাসে রয়েছে। তবে এখানে থালেও প্রতিনিয়ত তার মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। নতুন যাকে দেখছে তাকে নিজের মা মনে করে তার সাথে যাওয়ার জন্য আঁকুতি জানাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় আজিমপুর সরকারি ছোটমনি নিবাসের উপ-তত্ত্ববধায়ক জুবলি বেগম রানুর সাথে। সোনালীনিউজকে তিনি বলেন, আঁখি হচ্ছে হারানো বাচ্চা। দুই মাস হয়েছে এখানে এসেছে। ওকে পাওয়া গেছে ময়মনসিংহের ত্রিশালে একটি পার্লারের সামনে। ওকে পার্লারের কর্মরত একজন পেয়ে পুলিশের কাছে দেয়। পুলিশ ওকে তিন দিন ওই নারীর কাছে রাখে। ওর একটাই কান্না ‘আম্মু যাবো, আম্মু যাবো’। আসলে ওর একটা মা দরকার।
ছোটমনি নিবাসের উপ-তত্ত্ববধায়ক সোনালীনিউজকে আরও বলেন, আমি কোন বাচ্চাকে এতো কাঁদতে দেখিনি। একই কথা ‘আম্মু যাবো, আম্মু যাবো’। পুলিশ ওর মাকে কিশোরগঞ্জ থেকে খুজে বের করে। ওর বাবাকেও বের করে। মা একটা বিয়ে করছে। বাবাও আরেকটা বিয়ে করেছে। মা বিয়ে করছেন এক বছর হয়ে গেছে। তিনি যাকে বিয়ে করেছেন সেই ভদ্র লোক একেবারে গরিব। তারা আঁখিকে রাখলে তার মাকে রাখবে না। মাকে রাখলে আঁখিকে রাখবে না। ফলে আঁখির মা বাধ্য হয়েছে ওকে ছেড়ে দিতে। এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছে সে যেন কারও না কারও আশ্রয়ে যাবে। তাকে বসায়ে রেখে আসছে যতোটুকু বোঝা যায়। এটা আমাদের প্রথম থেকেই সন্দেহ বসায় রেখে সে পালিয়েছে।
জুবলি বেগম রানু সোনালীনিউজকে বলেন, পুলিশ মাকে খুঁজে নিয়ে আসলো। যে লোক মাকে বিয়ে করেছে তাকে একটা কাজও দেওয়া হয়েছিল কসাই খানায়। কিছু টাকা পয়সাও দিয়েছিল। পুলিশ আমাদের এখানে ঠিকানাও দিয়ে ছিলো যাতে বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে আঁখির মা আর আমাদের কাছে আসেনি এবং ওকে নেয়নি। ও শুধু কাঁদতো, প্রচুর কান্না করতো। একটানা ২০-২২ ধরে শুধু কান্না করেছে যে ‘আম্মু যাবো’। সে আমার কোল ছাড়তো না। ওর একটাই ধীর বিশ্বাস জন্মে গেছে যে আমিই হয়তো তাকে তার আম্মুর কাছে নিয়ে যাবো। আবার নতুন কাউকে দেখলে ভাবতো আমিতো দিলাম না, উনি হয়তো দেবে। তাকে জড়িয়ে ধরতো। পুলিশ ও পার্লারে সেই নারীর সাথে যোগাযোগ করেছি। কিশোরগঞ্জের ঠিকানায়ও পাওয়া যায়নি। আমাদের ওখানকার অফিসের সাথে যোগযোগ করেছি। সবার একই বক্তব্য ‘যে ইচ্ছে করে হারায় তাকেতো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
আঁখির একটা আম্মুর ব্যবস্থা হচ্ছে জানিয়ে সোনালীনিউজকে তিনি আরও বলেন, আমরা একটা চিন্তা করেছি ওরতো একটা আম্মু দরকার। ওর জন্য একটা মামলা কোর্টে হয়েছে। একজন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, ওনার স্ত্রী একটা ভালো চাকরি করেন। ওনারা আমাদের কাছে একটা বাচ্চার জন্য এসেছেন। তখন আমরা ওর সব ইতিহাস বলি। সব জেনে ওনারা ওকে নেওয়ার রাজি হয়েছে। কোর্টে একটা আবেদন করেছেন। এখন কোর্ট যদি সব জেনে বুঝে ওনাদেরকে দেন তাহলে-‘ওর একটা আম্মু হবে। আম্মু পাবে। আসলে ওর একটা স্থায়ী আম্মু দরকার। ও আম্মু চায়।’
আঁখির সবসময় দেখা শোনা করেন সেবিকা তানিয়া সুলতানা। সোনালীনিউজকে তিনি বলেন, ও এখানে আসার পর থেকে শুধু ‘মা মা’ বলে কান্না কাটি করতো। সে চাইতো এক্সটা একজন মানুষ তার যত্ব নেক। সবার কোলে সে যেতে চাইতো না। মা মা বলতো, সেই চাইতো যেকোন একজন শুধু ওকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, ওকে খাইয়ে দিবে। ওকে সময় দিবে, সেরকম চাইতো। তবে দিন দিন অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে মিশতে এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। অবশ্য ওর এখন একটা ব্যবস্থা হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে হয়তো ওর নতুন অভিভাবকের কাছে চলে যাবে।
কতটা দুর্ভাগা হলেই বাবা মা থাকার পরও অন্যদের কাছে মায়ের কোল খুজে বেড়াচ্ছে অভাগা আঁখি। অন্য বাচ্চারা খেলাধুলায় মেতে থাকলেও কোন এক কোণে বসে নিরবে অশ্রু ঝরে সময় কাটে আঁখির।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :