ঢাকা : করোনাকালে দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রধান অনুষঙ্গ মাস্ক নিয়ে ছিল নানারকমের কারসাজি, অহেতুক দাম বৃদ্ধির আলোচনা-সমালোচনা, আর বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি আদালতকেও হস্তক্ষেপ করতে হয় তখন। এই শীতে করোনার নতুন প্রজাতি মোকাবিলা নিয়ে চলছে প্রস্তুতি। নতুন রূপে করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় রয়েছে শঙ্কা। এরই মধ্যে আবার শুরু হয়েছে মাস্কসহ করোনা সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে কারসাজি।
সরকার ঘোষণা করেছে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’। শীত আসতে না আসতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং সরকার মাস্ক ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করার পর ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন করোনা সামগ্রীর। কিছুদিন আগেও সাধারণের নাগালে থাকা সার্জিক্যাল মাস্ক দ্বিগুণ দামে কিনতে হয়েছে মানুষকে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সপ্তাহখানেক আগে রাজধানীর অন্যতম পাইকারি বাজার মিটফোর্ড থেকে তারা মানভেদে ৫০ পিসের এক বক্স মাস্ক ৬০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ টাকায় কিনেছেন। এখন তা ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে তাদের।
হকাররা ৩টি মাস্ক যেখানে ১০ টাকায় বিক্রি করতেন, এখন তারা ১৫ টাকায় বিক্রি শুরু করেছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। শীত বাড়লে মাস্কের দাম আরো বাড়তে পারে বলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আগাম জানিয়ে দিয়েছেন বলেও জানান খুচরা বিক্রেতারা।
এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে সরকারকে বিনামূল্যে একাধিকবার ব্যবহারযোগ্য মাস্ক বিতরণ করার পরামর্শ দিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শীতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার সতর্ক করেছেন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে।
সম্প্রতি তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত। তবে জনগণকে মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক থাকতে হবে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ঘরের বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরা ছাড়াও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন। মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করছে। সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ সিদ্ধান্ত কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৫০ টাকার বক্স দেড়শ টাকা : গত মার্চে করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকে ক্রমেই বাড়তে থাকে মাস্কের চাহিদা। এই সুযোগে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভসসহ করোনার সুরক্ষা সামগ্রীর দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বাজার থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় এসব সামগ্রী। পরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞরা শীতে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশের পর আবার মাস্কের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা। খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে এসব তথ্য উঠে আসে।
শাহবাগের ঢাকা ফার্মা, আফতাব স্টোর, পপুলার ফার্মেসির কর্মীরা জানান, এত দিন ৫০ পিসের এক বক্স মাস্ক ৬০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ টাকায় কেনা যেত। এক সপ্তাহ ধরে ১২০ থেকে ১৪০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। শাহবাগের ফুটপাতে মাস্কসহ অন্যান্য সামগ্রী বিক্রেতা ফজলুর রহমান বলেন, ‘১ টাকা করে যে মাস্ক কিনতাম, আজকে মিটফোর্ড থেকে ৩ টাকা পিস কিনলাম। দোকানদার বলছে দাম আরো বাড়বে।’
কী কারণে দাম বাড়ছে বলে মনে করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শীতে করোনা বাড়বে, তাই অনেকে স্টক করে রাখতেছে। মাল (মাস্ক) কম ছাড়তেছে।’ বিএসএমএমইউর ফটকের পাশে বিকাশের সঙ্গে মাস্ক বিক্রি করেন সবুজ মিয়া।
তিনি বলেন, ‘আগে তিন পিস ৫ টাকায় বিক্রি করলেও এখন ১টা ৫ টাকা করে বিক্রি করতেছি। কয়েক দিন পর ১০ টাকা পিস বেচতে হবে। অবস্থা ভালো না।’
কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা : মাস্ক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীতে করোনার সংক্রমণ বাড়বে এটা ধরে রেখে পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন বড় ব্যবসায়ীরা।
এ ছাড়া এত দিন বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন করে মাস্ক তৈরি এবং আমদানিতে যুক্তরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সরকার মাস্ক ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করায় এবং সংক্রমণ বাড়ায় চাহিদা বেড়ে গেছে, তাই দাম বাড়ানো হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ক্ষুদ্র মাস্ক ব্যবসায়ী বলেন, ‘করোনায় অনেকে নতুন করে মাস্ক ব্যবসায় এসে অনেক টাকা লস করেছে। কারণ বড় আমদানিকারকরা কম লাভে মাস্ক বিক্রি করায় ছোটরা কুলিয়ে উঠতে পারেনি। এখন আবার চাহিদা বাড়তেছে দেখে দাম বাড়তির দিকে। সামনে আরো বাড়বে।’
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে আসলে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর। চাহিদা বাড়লে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়। এখন যেমন হচ্ছে। সরকারকে বেশি বেশি অভিযান চালাতে হবে। পাশাপাশি একাধিকবার ব্যবহার করা যায় এমন মাস্ক বিনামূল্যে দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। বিত্তশালীরাও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারেন। এতে জনসেবাও হবে, মানুষ উপকার পাবে।’
আর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, একাধিক টিম অভিযান চালাচ্ছে। এভাবে মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রীর দাম নিয়ে কারসাজি করলে কেউ রেহাই পাবে না।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :