ঢাকা : দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে ২০২১ সালে। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর এ বছরেই করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলাসহ আর্থসামাজিক নানা সংকট সমাধানেরও চ্যালেঞ্জ আছে বাংলাদেশের সামনে। সবমিলিয়ে বলা হচ্ছে সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জের মিশেলে ২০২১ সাল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বছর। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : চলমান মুজিব জন্মশতবার্ষিকীর সমাপনী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে নতুন বছর জুড়েই নানা উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা চলছে।
সরকারের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও সুবর্ণজয়ন্তী পালনের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা করতে শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি।
মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক বলেন, সম্মানজনকভাবে আমরা আমাদের এই সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে পারি সেজন্য সাধ্যমত আমরা চেষ্টা করবো।
"আশাকরি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে হয়েছে তার চেয়ে আরো ভালভাবে এটা করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে। বিশ্ববাসীর কাছে যাতে আমাদের এ খবর পৌঁছে যায় সে উদ্যোগও আমাদের থাকবে" বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বর্ণাঢ্যভাবে উদযাপনের প্রস্তুতি থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে মুজিব বর্ষের অনেক অনুষ্ঠান সীমিত আকারে পালিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনেও বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে, এমন আশঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, "আমরা আশা করছি মার্চ মাসের পর এই দেশের এবং বিশ্বের অবস্থার পরিবর্তন হবে। ভালভাবে আমাদের কর্মসূচী পালন করতে পারবো। তারপরও যদি বাস্তবতা ভিন্নরকম থাকে তাহলে সংক্ষিপ্তভাবে করতে হবে।"
নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বছরে মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মতো নানারকম চ্যালেঞ্জও রয়েছে বাংলাদেশের সামনে।
নতুন বছর শুরুই হচ্ছে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ দিয়ে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ এবং সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এখন একাধিক ভ্যাকসিন অনুমোদন পাওয়ায় সবার জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা এবং জনস্বাস্থ্য সমস্যাকে মোকাবেলা একটা বড় কাজ হবে সরকারের।
নতুন বছরকে সামনে রেখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাহফুজা রিফাত বলেন, "আমরা একটা ভাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখতে চাই। আরেকটি বিষয় হলো স্বাস্থ্যের যে নির্নায়কগুলোতে আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম, খুব ভাল করছিলাম সেগুলো করোনার কারণে পিছিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।"
"সেই যায়গাগুলো আমরা কীভাবে আবার যেতে পারবো, ২০২১ সালে আমরা আবার সেগুলো সামনে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি সেজন্য আমাদের একসাথে কাজ করে যেতে হবে" বলে তিনি বলেন।
যেহেতু বিশ্বে একাধিক ভ্যাকসিন অনুমোদন পেয়ে গেছে আর অনেক দেশে গণহারে টিকা কর্মসূচীও শুরু হয়েছে, তাই বাংলাদেশে টিকা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও কিছু চ্যালেঞ্জ থাকবে বলে মনে করেন মিজ রিফাত।
"আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতে সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং দ্বিতীয়ত অগ্রাধিকারের প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।"
তিনি আরও বলেছেন, "বলা হচ্ছে যে পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেয়া হবে কিন্তু সেখানেও একটা স্বচ্ছতার বিষয় থাকতে হবে যে কাকে দেয়া হবে । এই পরিকল্পনাটা এখানে জরুরি এবং যেটা সামনের দিনে আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।"
অর্থনীতি : করোনাভাইরাস মহামারি হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতি এবং জীবন-জীবিকার জন্য।
নতুন বছরে প্রবৃদ্ধি আর অর্থনীতির চাকা সচল রেখে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এবং আয় বৈষম্য নিরসন কতটা হবে , তার দিকে দৃষ্টি অর্থনীতিবিদদের।
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, করোনভাইরাসের কারণে যে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, সেটা কিন্তু কাটিয়ে উঠতে পারিনি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, এটা হয়তো ২০২১ সালের শেষভাগে বা ২০২২ এ গিয়ে আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো, যদি না করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে না যায়।
"২০২১ সালে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমাদের যেসকল ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প কল-কারখানা যেগুলো সমস্যায় আছে, যার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজগুলো ঘোষণা হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করা। অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য প্রয়োজনে নতুন প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।"
করোনাভাইরাস মহামারিতে নতুন কিছু সুযোগেরও সৃষ্টি হয়েছে যা কাজে লাগানো প্রয়োজন হবে নতুন বছরে।
এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে বছরের শুরুতেই।
ড. নাজনীন বলছেন, "কর্মসংস্থানের যে চ্যালেঞ্জটা ২০২০ সালে এসেছে সেটা নিশ্চিতভাবেই ২০২১ সালে থাকবে। যেসকল নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে সেগুলোকে যেন আমরা কাজে লাগাতে পারি।"
কূটনীতির চ্যালেঞ্জ : মহামারি পরবর্তী নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় কূটনৈতিক দিক থেকে নানা চ্যালেঞ্জ থাকবে বাংলাদেশের জন্য। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নানা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ট যোগাযোগ এবং গভীর সম্পর্ক আছে ভারতের সঙ্গে। নতুন বছরে মহামারি মোকাবেলা এবং ভ্যাকসিনের মতো বিষয় ছাড়াও বহু কারণে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকবে বাংলাদেশের।
নতুন বছরে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দল বিজেপির মধ্যে লড়াই নিয়ে নানা সমীকরণ আছে।
একদিকে তিস্তা চুক্তি অন্যদিকে এনআরসি ইস্যু- এমন প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের ভোট বাংলাদেশের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে।
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বিশ্লেষক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের সাথে কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিগত ভাষাগত বেশ মিল রয়েছে। সে কারণেই কিন্তু আমরা এটাকে গুরুত্ব দেই। এনআরসি এবং তিস্তা ইস্যু কিন্তু আরো বেশি এই হাইপটাকে তুলে ধরেছে। কিন্তু আমি মনে করি এই হাইপটাকে একটু সংযতভাবে আমাদের দেখতে হবে।"
তিনি মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর কী হবে না হবে তার সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতির একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে।
বাকস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা : নতুন বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর মুক্তচিন্তার প্রশ্নে উদ্বেগ থাকছে বরাবরের মতোই।
বিদায়ী বছরে, স্বাধীন মত প্র্রকাশে বাধা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়রানির অভিযোগ, এমনকি চলচ্চিত্রে কাল্পনিক চরিত্রে পু্লিশকে হেয় করার অভিযোগে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। ২০২১ সালেও স্বাধীন চিন্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা হুমকিতে পড়বে কিনা সে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
তাহমিনা রহমান দীর্ঘ সময় ধরে বাক স্বাধীনতা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইস্যু নিয়ে সোচ্চার।
তিনি বলেন, "রাষ্ট্র বলছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য। আমি বলবো যে এই আইনটি সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ। কিন্তু এই আইনের ভেতরেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মত প্রকাশের ওপরে নানারকম ধারা রয়েছে যেগুলো নাকি মানহানি, ডিজইনফরমেশন বা মিস ইনফরমেশনের নামে যারা মন্তব্য করছেন অনলাইনে বা তথ্য প্র্রকাশ করছেন, তাদের ওপরে আঘাত আসছে। এটা যেন না ঘটে সেটার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে।"
সবমিলিয়ে নতুন বছরে মহামারি অর্থনীতি রাজনীতি, গণতন্ত্র, ছাড়াও সুবর্ণজয়ন্তীর বছরেও বাংলাদেশের সামনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের মতো চ্যালেঞ্জও থাকবে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :