• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
অন্য রোগে আক্রান্তরাই মারা যাচ্ছেন বেশি

মৃত্যুর কারণ শুধু করোনা নয়


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ২০, ২০২১, ০৩:৫৫ পিএম
মৃত্যুর কারণ শুধু করোনা নয়

ঢাকা : দেশে করোনা সংক্রমণ ফের বেড়েছে। গত বছরের মতোই হাসপাতালগুলো করোনা রোগীতে ভরে উঠছে। পাশাপাশি বেড়েছে মৃত্যুর হারও। তবে মৃত্যুর কারণ কেবল করোনা নয়। অন্য রোগে আক্রান্তের যদি করোনা হয়, সে ক্ষেত্রে মৃত্যুহার বেশি হচ্ছে।

এ অবস্থায় করোনার পাশাপাশি যেসব রোগীর অন্য রোগ রয়েছে, তাদের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সব রোগের সমন্বিত চিকিৎসার মাধ্যমেই মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন বয়স্করা। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে অন্যান্য রোগ। গত কয়েক দিন মারা যাওয়াদের মধ্যে বেশির ভাগেরই বয়স ৬০ বছরের বেশি। ঠিক কোন কারণে কোন পরিস্থিতিতে মৃত্যু হচ্ছে তার পর্যালোচনা দরকার। তাতে অন্তত কিছু মৃত্যু কমানো সম্ভব হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠন করা পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটি করোনাতে মৃত্যু কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে জানিয়ে বলেছিল, করোনাতে শূন্য মৃত্যুর টার্গেট নিয়ে কাজ করতে হবে। আর এ জন্য গত ১৭ জুন তারা একটি লিখিত প্রতিবেদন দেয়, যেখানে কাজটি কীভাবে করতে হবে তার কিছু দিকনির্দেশনা ছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯২ শতাংশই মারা গেছেন আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ১৪ দিনের মধ্যে। আর ২৮ দিনের মধ্যে মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষ ৭৬ শতাংশ আর নারী ২৪ শতাংশ।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) কোভিড-১৯ রোগীদের পরিণতির সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিসমূহ নিরূপণ শিরোনামে একটি গবেষণা করে। এতে দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের সংক্রমিত হয়ে প্রথম ১৪ দিনের মধ্যে মৃত্যুহার দুই দশমিক তিন শতাংশ আর ১৫ দিন থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক দুই শতাংশ। অর্থাৎ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯২ শতাংশই মারা গেছেন প্রথম ১৪ দিনের মধ্যে। আর তাদের মধ্যে ৭৮ দশমিক তিন শতাংশের এক বা একাধিক অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন। যারা ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের ৮০ শতাংশের ছিল অন্যান্য রোগ।

গবেষণা বলছে, যারা ১৪ দিনের মধ্যে মারা গেছেন তাদের মধ্যে তিন বা তিনের বেশি অন্য রোগ ছিল শতকরা ৩৩ দশমিক দুই শতাংশ রোগীর, দুটি অন্য রোগ ছিল ২৭ দশমিক আট শতাংশ আর একটি অন্য রোগ ছিল এমন রোগীর সংখ্যা ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ১৪ দিনের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের ৩৯ দশমিক এক শতাংশের শ্বাসতন্ত্রের জটিল রোগ বা সিওপিডি ছিল, ৩৯ দশমিক এক শতাংশের ডায়াবেটিস, ৩৪ দশমিক আট শতাংশ ছিল উচ্চ রক্তচাপ, ১৭ দশমিক চার শতাংশের ছিল হূদপিণ্ডের রক্তনালির রোগ আর দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে ভুগছিলেন সাত দশমিক চার শতাংশ রোগী।

অন্যদিকে ২৮ দিনের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশের ছিল শ্বাসতন্ত্রের জটিল সংক্রমণ, ৩৬ শতাংশের ডায়াবেটিস, ৩৬ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, ১৬ শতাংশের হূদপিণ্ডের রক্তনালির রোগ ও দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ ছিল ১৬ শতাংশের। ১৪ দিনের ভেতরে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ষাট এবং ষাটোর্ধ্ব ছিলেন ৬০ দশমিক নয় শতাংশ বাকিদের বয়স ৫৯ এর কম। তাদের মধ্যে ৭৮ দশমিক তিন শতাংশ পুরুষ আর ২১ দশমিক সাত শতাংশ নারী। ২৮ দিনের মধ্যে মারা যাওয়াদের  ৫৬ শতাংশের বয়স ষাট বা ষাটোর্ধ্ব, তাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ পুরুষ আর বাকি ২৪ শতাংশ নারী।

করোনায় মৃত্যু নিয়ে কাজ করেছে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এ হাসপাতালের ইতোমধ্যে করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ৩০০ পার হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২০২ জনের মৃত্যু নিয়ে তারা বিশ্লেষণ করেছে।

হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, কোমরবিডিটি অর্থাৎ অন্যান্য জটিল রোগের আক্রান্তদের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ছিল উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস। ১৩১ জনের উচ্চ রক্তচাপ, ১২৫ জনের ডায়াবেটিস ছিল, সিকেডি অর্থাৎ হূদরোগ আর তারপর ছিল অ্যাজমা। শ্বাসকষ্ট নিয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী এসেছিলেন এই হাসপাতালে, তারপর জ্বর-কাশি, ডায়রিয়া নিয়েও রোগীরা এসেছেন।

বেশির ভাগ রোগী মারা গিয়েছেন শূন্য দিন অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুই দিনের ভেতরে। অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার ভেতরেই বেশির ভাগ রোগী মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ২৫ জন মারা গেছেন জিরো আওয়ারে অর্থাৎ হাসপাতালে আসার পর পরই। এর পেছনে রয়েছে রোগীরা হাসপাতালে না আসা, স্বীকার না করার মতো বিষয়গুলো। মারা যাওয়াদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে একই সঙ্গে আক্রান্তদের সংখ্যাই বেশি, প্রায় ৮৫ জন।

মৃত্যু কমানোর জন্য গত অক্টোবর থেকে ফরমাল স্টাডি করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটি। সারা দেশ থেকে ১০টি হাসপাতাল নিয়ে কাজ করছে কমিটি। তার মধ্যে রংপুর ও বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রামের দুটি এবং বাকি ছয়টি হাসপাতাল ঢাকার। এরমধ্যে ৭২০টি মৃত্যু রিভিউ করার পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যে কমিটি পেয়েছে ৬১৬টির তথ্য তারা পেয়েছে।

এ বিষয়ে কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, গত অক্টোবর থেকে কেবল হাসপাতালের কেস রেকর্ড রিভিউ করে কেন মৃত্যু হয় বা হচ্ছে, সেটা বের করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই ডেটা কালেকশন আমরা এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারিনি। এখন পর্যন্ত ঢাকার হাসপাতালগুলোতে আটকে আছি। তবে আশা করছি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এর প্রাথমিক ফলাফল সবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারব। মৃত্যু কমানোর জন্য হাসপাতালে আর কী কী করা যেত বা কী করা উচিত-এমন কিছু দিকনির্দেশনা তখন দিতে পারব।

আবু জামিল আরো বলেন, আমরা মনে হয় মৃত্যু কমানোর জন্য দুটো বিষয়ে ঘাটতি ছিল। মানুষকে আমরা ভালোভাবে রিস্ক কমিউনিকেট করতে পারিনি। অর্থ্যাৎ কোন পর্যায়ে গেলে মানুষ হাসপাতালে যাবে বা যেতে হবে-সেটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি।

এ ছাড়া প্রতিটি হাসপাতাল নিজস্ব ম্যানেজমেন্টে  চলেছে। তবে আমরা এখনো মৃত্যুর ঝুঁকি কী করে কমানো যায় সেটা মানুষকে বোঝানোর মধ্য দিয়ে  মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পারি। মানুষকে বোঝাতে পারলে তারা সচেতন হবে, সঠিক সময়ে হাসপাতালে যাবে।

নিপসমের পরিচালক অধ্যাপক বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য একটি ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন রয়েছে। আর আমাদের গবেষণাতে প্রথম ১৪ দিনের ভেতরে যেহেতু মৃত্যুহার বেশি, তাই প্রথম ১৪ দিনের যে চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা নীতিমালায় রয়েছে, সেটা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা উচিত বলে আমরা সুপারিশ করেছি। একই সঙ্গে মৃত্যুহার এবং অসুস্থতার হার কমাতে হলে বৃদ্ধ এবং কোমরবিডি অর্থ্যাৎ যারা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসায় বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে যেসব হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য যেন অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ মার্চে দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয় বলে জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রথম তিন রোগী শনাক্তের ঠিক ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চে করোনায় আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যুর কথাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

বিদেশ ফেরত স্বজনের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন পুরুষ এবং তার বয়স ছিল ৭০ বছরের বেশি।

আইইডিসিআরের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সেদিন বলেন, ওই ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন, পাশাপাশি তার হার্টে স্টেন্ট পরানো ছিল।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!