• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

ভয়াবহরূপে করোনা, কারফিউ জারির তাগিদ


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ২, ২০২১, ০২:৪২ পিএম
ভয়াবহরূপে করোনা, কারফিউ জারির তাগিদ

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা : দেশে ভয়াবহরূপে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতি বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। দেশে গড় শনাক্তের হার ২৩ শতাংশে পৌঁছে গেছে। রাজধানীর কোনো কোনো আরটিপিসিআর ল্যাবে শনাক্তের হার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।

ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৩০ জেলাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এসব জেলায় সংক্রমণের হার ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। শনাক্ত ও মৃত্যুর হার প্রতিদিন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে।

দেশের করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠার আগেই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে এখনই, এই মুহূর্তে কমপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য ঢাকাসহ সর্বোচ্চ সংক্রমণ প্রবণ ৫টি শহরে কারফিউ (লকডাউনের আদলে) জারি করতে হবে।

বাকি ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতে কঠোরভাবে সরকার নির্দেশিত ১৮ দফা বিধিনিষেধ প্রতিপালন করতে হবে। অন্যথায় আসছে সপ্তাহে দৈনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

তাদের আরও অভিমত, রোগতত্ত্ববিদ এবং জনস্বাস্থ্যবিদরা করোনা পরিস্থিতি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। ফলে গত ১৬ তারিখে একটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এ সংক্রান্ত একটি সভা করে ১২ দফা সুপারিশ প্রদান করেন। কিন্তু সেই সুপারিশ সরকার আমলে নেয়নি। এরপর সংক্রমণ পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করলে ২৮ মার্চ অধিক সংক্রমিত এলাকার জন্য কঠোর বিধিনিষেধসহ ২২ দফা এবং অপেক্ষাকৃত কম সংক্রমণপ্রবণ এলাকার জন্য ১৮ দফা সুপারিশ প্রদান করেন তারা।

সরকারের সংশ্লিষ্টরা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত আমলে না নিয়ে সারা দেশের জন্য ১৮ দফা নির্দেশনা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করেন। এমনকি মেলা, বিপণিবিতান, খেলা, পাবলিক পরীক্ষা ইত্যাদি স্বাভাবিক নিয়মে চালানোর সিদ্ধান্তও পরিবর্তন করেনি সরকার। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এ ধরনের আচরণে হতবিহবল হয়ে পড়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভায় রোগীর সেবা বাড়ানো, বিনোদন কেন্দ্র, বইমেলা ও অন্যান্য মেলা বন্ধ করাসহ পাঁচ দফা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে লকডাউন দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

বিশেষ সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ৫টি জেলায় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মৌলভীবাজার) কারফিউর আদলে লকডাউন দিতে হবে। লকডাউন ঘোষণা-পরবর্তী ১৪ দিন কঠোরভাবে সেটি প্রতিপালন করতে হবে। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় এক বা দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হবে। যখন সবাই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো কিনতে পারে।

অধ্যাপক সায়েদুর বলেন, এছাড়া উচ্চ সংক্রমণপ্রবণ ৩০টি জেলায় সরকারি নির্দেশিত ১৮ দফা কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। অন্যথায় আগামী সপ্তাহে দেশে দৈনন্দিন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অব্যাহত বৃদ্ধির ধারায় গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত রোগীর নতুন রেকর্ড হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৬ হাজার ৪৬৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে আরও ৫৯ জনের।

বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, যেভাবে প্রতিদিন করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে, এভাবে চলতে থাকলে দেশে কোনো হাসপাতালেই রোগী রাখার জায়গা থাকবে না।

এজন্য করোনার বৃদ্ধি ঠেকাতে দলমত নির্বিশেষে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে এখনই। প্রধানমন্ত্রীর ১৮টি নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নসহ সব স্থানে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলতে না পারলে আগামীতে এই প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান বলেন, আমাদের পিসিআর ল্যাবে গত বছরের মধ্যে গত চব্বিশ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪৫৫৬ (চার হাজার পাঁচশ ছাপ্পান্ন)টি কোভিড-১৯ আরটি পিসিআর পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে।

তার মধ্যে ১০৮৭ জনের পজিটিভ পাওয়া গেছে। যা মোট পরীক্ষিত নমুনার ২৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় তিনি সবাইকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গত বছর ৮ মার্চ করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পর গত সোমবার প্রথমবারের মতো এক দিনে পাঁচ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্তের খবর আসে।

তার মধ্য দিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছয় লাখ ছাড়িয়ে যায়। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ দেশে করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিল সরকার, বুধবার তা নয় হাজার ছাড়িয়ে যায়।

পরামর্শক কমিটির সুপারিশ : দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভায় পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শহিদুল্লা কমিটির পক্ষে সুপারিশগুলো গণমাধ্যমে পাঠান।

এগুলো হচ্ছে-

০১. প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ কমানোর লক্ষ্যে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। পরামর্শক কমিটি এই নির্দেশনা জারিকে স্বাগত জানায় এবং ধন্যবাদ জানায়। তবে এগুলো কার্যকর করার জন্য বাস্তবায়ন কর্মসূচি বা প্রস্তুতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন।

০২. হাসপাতালসমূহে যথাসম্ভব কোভিড-১৯ রোগীর শয্যা সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। আইসিইউতে শয্যা বাড়ানো দরকার। ঢাকার বাইরে মেডিকেল কলেজগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে সেখানে এলাকার রোগীর চিকিৎসা করা দরকার।

০৩. কোভিড-১৯ এর জন্য টেস্ট করতে আসা মানুষ যাতে সহজে সেবা পায় তার ব্যবস্থা করা দরকার। আগামী দিনগুলোতে করোনা টেস্ট করার চাহিদা বাড়তে পারে, সেটি মাথায় রেখে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি প্রয়োজন।

০৪. রোগ প্রতিরোধের জন্য অবিলম্বে সামাজিক অনুষ্ঠান, বিনোদন কেন্দ্র, বইমেলা ও অন্যান্য মেলা বন্ধ করা দরকার। পরিবহণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা। এ সম্পর্কে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সব নির্দেশনা যাতে পালন করা হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে দিকনির্দেশনা নেওয়া যেতে পারে।

০৫. টিকাদান-পরবর্তী সার্ভিলেন্সের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য জেনেটিক সিকুয়েন্সিং করা দরকার। এজন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!