• ঢাকা
  • বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

নিষেধাজ্ঞা মানেননি নগরবাসী


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ৬, ২০২১, ০১:০৬ এএম
নিষেধাজ্ঞা মানেননি নগরবাসী

ঢাকা : মহামারী করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশজুড়ে দ্বিতীয় দফা লকডাউন বা সরকারি কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে।

অথচ সোমবার (৫ এপ্রিল) প্রথম দিনেই রাস্তা, বাজারসহ সব স্থানেই হাজারো মানুষের ভিড় দেখে মনে হয়েছে, দেশ করোনামুক্ত হয়ে গেছে। একই সাথে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ির দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই, কেউ মানতে রাজি নন সরকারের জারি করা নির্দেশনা।

সড়ক আর অলিগলিতেও ছিল হাজারো মানুষের আড্ডা। এমনকি রাজধানীর অনেক সড়কে দেখা গেছে যানজট। সকাল থেকেই হাট-বাজারে ছিল সেই চিরচেনা ভিড়। ঢিলেঢালা লকডাউন আর সাধারণ মানুষের আচরণ সব মিলে প্রত্যাশার লকডাউন নেই বললেই চলে। আর সরকারি বিধিনিষেধ মানাতে পুলিশ প্রশাসনেরও ছিল ঢিলেঢালা মনোভাব।
সোমবার (৫ এপ্রিল) সকাল ৬টা থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশব্যাপী এই লকডাউন শুরু হয় সাত দিনের জন্য। সময় বাড়ানো না হলে কার্যকর থাকবে আগামী ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত। নির্দেশনা অনুযায়ী সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ আছে। বন্ধ হয়ে গেছে আন্তঃজেলা বাস ট্রেন-লঞ্চ চলাচল। ফলে প্রথম দিনে অফিসগামীদের রিকশা, সিএনজি-চালিত অটোরিকশা এবং প্রাইভেট কারে যাতায়াত করতে দেখা যায়। কর্মস্থলে কর্মীদের উপস্থিতি সীমিত করার নির্দেশ থাকলেও অনেক অফিসই সে নির্দেশনা মানেনি। ফলে পরিবহন সংকট থাকা সত্ত্বেও অনেককেই অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

এ ছাড়া রাজধানীর কয়েকটি মোড়ে যানজটের খবর পাওয়া গেছে। লকডাউনে জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে না বেরুনোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার।

সরেজমিন দেখা গেছে, যাত্রীবাহী বাস বন্ধ থাকলেও সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ চোখে পড়ার মতো। এমনকি যানজট এড়াতে বিভিন্ন মোড়ে ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তার সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। সিএনজি অটোরিকশা ও প্যাডেল রিকশায় গাদাগদি করে লোকজনকে চলাচল করতে দেখা গেছে। আবার গণপরিবহন চলাচল না করায় অনেককে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা যায়।

সকালে রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাজলা মোড় থেকে রায়েরবাগ পর্যন্ত যানজট ছিল। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে শত শত প্রাইভেটকার, ট্রাক, লেগুনা ও দূরপাল্লার বাস। গাদাগাদি করে ট্রাকেও মানুষকে চলাচল করতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে অনেকেই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। সকাল ১০টার দিকে শনিরআখড়ায় কথা হয় ট্রাকচালক মনিরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ৯টা থেকে জ্যামে বসে আছি। জানি না কতক্ষণ থাকতে হবে। শুনেছি চিটাগাং রোড পর্যন্ত যানজট।

এদিকে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে দূরপাল্লার বাসে যাত্রীদের ঢাকায় আসতে দেখা গেছে। গণপরিবহন বন্ধের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে ঢাকায় আসা এসব মানুষ এবং অফিসগামী যাত্রীদের। এ সুযোগে বাড়তি ভাড়া দাবি করছেন সিএনজি  অটোরিকশা চালকরা।

রায়েরবাগে কথা হয় লুৎফল কবীর চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি ধানমন্ডিতে একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি করেন। লুৎফল কবীর বলেন, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। কোনো যানবাহন পাচ্ছি না। কীভাবে যাব, সে চিন্তা করছি। আল আরাফাহ ব্যাংকের কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকও দাঁড়িয়ে ছিলেন একই জায়গায়।

তিনি বলেন, অফিস খোলা। অথচ গাড়ি নেই। আমার মতো অনেক মানুষ আছেন, যাদের অফিসের পক্ষ থেকে কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। সড়কে এসে তাদেরও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

এদিকে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় গাড়ি না পেয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে অফিসগামী সাধারণ মানুষ। এতে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। গতকাল সকাল ৯টার দিকে তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ শুরু করেন।

অবরোধকারীরা বলেন, সড়কে প্রায় সব ধরনের যানবাহনই চলাচল করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাহন, ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ট্রাক চলছে স্বাভাবিকভাবেই। সরকারের নির্দেশনার কারণে প্রায় সকল কারখানা খোলা রয়েছে। কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারীদের যাতায়াতের জন্য গাড়ির তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় তাদের কর্মস্থল খোলা থাকলেও তারা পরিবহন সংকটে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না।

আল মামুন নামে একজন অবরোধকারী বলেন, কারখানা খোলা রয়েছে। আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পৌঁছাতে বলা হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় এসে দেখি যাওয়ার জন্য বাস নেই। যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তারা ঠিকই অফিসে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যেতে পারছি না। এক জায়গায় দুই অবস্থা, এটা হতে পারে না। হয় সবার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে, না হয় সব কিছু বন্ধ করতে হবে।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশ এসে অবরোধকারীদের সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে। এরপর দেখা যায় বাস না পেয়ে অফিসগামীরা ৪-৮ জন করে  ভ্যানে চড়ে বসেছেন।

ভ্যানযাত্রী সোহাগ মিয়া বলেন, আমাদের এখন এমন অবস্থা যে, করোনার থেকেও অফিসে সময়মতো উপস্থিত না হতে পারাকে বেশি ভয় করি। দেশে সাত দিনের লকডাউন দিলেও আমাদের অফিস তো খোলা। আমরা তো অফিস থেকে অনেক দূরে থাকি। বাস চলছে না কি করে অফিসে সময়মতো হাজিরা দেব। তাই অন্য দিনের তুলনায় দেড় ঘণ্টা আগেই অফিসের উদ্দেশে রওনা করেছি। আর অফিসে যাওয়ার জন্য কোনো যানবাহন পাচ্ছি না। রিকশাচালকরা কয়েকগুণ বেশি ভাড়া চাচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে ভ্যানে চড়েছি। অফিসে যেতে এভাবে নানা উপায় বেছে নিচ্ছেন কর্মজীবী মানুষ।

এদিকে যানবাহন না পেয়ে অফিস থেকে দেড়-দুই ঘণ্টার পথ পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরতে দেখে গেছে হাজারো নারী-পুরষকে।  

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটর, মানিক মিয়া এভিনিউসহ বিভিন্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়েনি। অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে চলছে লকডাউন। যে যার মতো পারছে বাসা থেকে বের হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে লকডাউন কতটা সফল হবে সেই প্রশ্ন অনেকের।

এদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান খুলতে চেয়ে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় দোকানপাট খোলা রাখার দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ করছেন ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। গাদাগাদি করে বিক্ষোভ সমাবেশে ব্যবসায়ীরা স্লোগান দেন, এবারের লকডাউন মানি না, মানব না। স্বাস্থ্যবিধি মানব, দোকানপাট খুলব।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সরকার দোকান খোলার সময়সীমা বেঁধে দিলে আমরা উপকৃত হব। ওই সময়ের মধ্যে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা করতে চাই। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনায় মরতে হবে। আর দোকানপাট বন্ধ থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। এখন দুদিকেই মরণ। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা দোকান খোলা রাখতে চাই। কারণ এই একটা দোকানের আয় দিয়ে আমাদের পরিবার চলে। আয় না থাকলে আমরা চলব কী করে।

বিক্ষোভে থাকা এক ব্যবসায়ী বলেন, লকডাউনে ব্যবসায়ীদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। গত বছর লকডাউনের কারণে তিন মাস আমরা ব্যবসা করতে পারিনি। তখন দোকান বন্ধ থাকার কারণেও দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়েছে। তিন মাস লকডাউনের পর ৯ মাস ব্যবসায় লোকসান গুনতে হয়েছে। এবার লকডাউন খুলে সীমিত আকারে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হোক। এখানে অনেক ব্যবসায়ী ভাই আছেন, যারা লোকসানে আছেন।

নিউমার্কেটের ইসমাইল ম্যানসনের এক দোকানি বলেন, গত বছর করোনায় আমাদের অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে। এবার যদি লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকে তবে আমরা না খেয়ে মরব। তা ছাড়া রমজানের এক মাসে বেচাকেনার জন্য বাকিতে লাখ লাখ টাকার পণ্য স্টক করা হয়েছে। যদি দোকান না খুলতে পারি তবে ওই টাকা পরিশোধ করব কীভাবে আর নিজেরা বাঁচব কীভাবে।

অন্যদিকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ঢিলেঢালা লকডাউনের খবর পাওয়া গেছে। আমাদের প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী, বেশিরভাগ শহরেই লকডাউন বাস্তবায়নে সকাল থেকে মাঠে তেমন দেখা মিলেনি প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। ফলে সারাদিনই খোলা ছিল সব নিত্যপণ্যের দোকানসহ অন্যান্য অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণার বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। গতকাল বিকেল ৩টা থেকে নগরীর নিউমার্কেট মোড় অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করছেন হাজারো ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, রাস্তাঘাট সব কিছুই স্বাভাবিক এবং যানবাহন চলছে। তাই তারা চান সীমিত পরিসরে হলেও তাদের দোকান খুলতে দেওয়া হোক। কারণ আসন্ন রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন।

একইভাবে দ্বিতীয় দফা লকডাউনের প্রথম দিনে বরিশালে, সিলেট, ময়মনসিংহ, খুলনা ও কুমিল্লায় তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। যে যার মতো অবাধে রাস্তায় চলাফেরা করছেন। কেউ আবার কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ দোকানের পুরো শাটার, কেউ আবার অর্ধেক শাটার খুলে দেদার বিক্রি করছেন। ফলে নগরীতে ক্রেতা ও পথচারীদের সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। এদের মধ্যে কারো মুখে মাস্ক, কারো থুতনির নিচে মাস্ক, আবার কারো মুখে মাস্ক নেই। গণপরিবহন ও যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ থাকলেও সড়কগুলোতে রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি, মাহিন্দ্রা অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!