ঢাকা : করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। কয়েক দফায় এ লকডাউনের বিধিনিষেধে কিছু শিথিলতাও আনা হয়।
কিন্তু দিন যত যাচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাও তত বাড়ছে। বিশেষ করে রোজার শেষ দিকে দেশজুড়ে চলছে স্বাস্থ্যবিধি না মানার ধুম। রাস্তাঘাট, মার্কেট-শপিংমল, বাজার, গণপরিবহন কোথাও কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানতে রাজি নন।
আর ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে রাজধানী ছেড়ে বাড়ি ফেরার হিড়িক পড়েছে তত বেশি। যে যেভাবে পারছে, ছুটছে নাড়ির টানে বাড়ি। বিভিন্ন ফেরি ও লঞ্চঘাটে মানুষের ঢল দেখে আতঙ্কিত সচেতন মানুষ। কারণ এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সবাই। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাই তো ফেরিঘাটে বিজিবি নামিয়েও সাধারণ মানুষের বাড়ি ফেরা আটকানো যাচ্ছে না। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঈদকে ঘিরে সাধারণ মানুষের ছোটাছুটি বন্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। শুধু বার বার যে যার অবস্থান থেকে ঈদ উদ্যাপনের আহ্বান জানিয়ে দায় সারছেন তারা।
এর আগে খোদ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, আমরা ভালোর জন্যই বলেছিলাম। কিন্তু যা অবস্থা দেখছি, তা ১৪ দিন পরে কি হয় সেটি দেখার পালা। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবনের প্রয়োজনে যে যার অবস্থানে থেকে ঈদ উদ্যাপনের নির্দেশনা দেন।
তবে এবার করোনা সংক্রমন বৃদ্ধির আতঙ্ক তৈরি করেছে নৌপথের যাত্রীরা। কারণ দুরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকায় ঈদে বাড়ি ফিরতে কয়েকদিন ধরেই মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রী ও যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ। একই অবস্থা পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটেও। ফেরিতে যাত্রীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ঘাট কর্তৃপক্ষ। অবশেষে শনিবার রাত থেকে সেখানে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। তারপরও কাজ হচ্ছে না। শুক্রবার, শনিবার ও গতকাল রোববার লাখো মানুষ এ পথে বাড়ি ফিরেছেন কেউ মানেনি কোনো স্বাস্থ্যবিধি।
জানা গেছে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা কাজির হাট নৌরুটে ২০টি ফেরি রয়েছে। যানবাহন ও যাত্রীর চাপ থাকায় ৬টি ছোট ফেরির পাশাপাশি ৪টি বড় ফেরি পারাপারে কাজ করছে। সরকারে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এসব ফেরিতে ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে গাদাগাদি করে ঘরে ফিরছেন যাত্রীরা।
শিমুলিয়া ফেরিঘাট ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই আস্তে আস্তে ঘাটে মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। গতকাল রোববার সকালেও ঘাটে যাত্রীদের ভিড় লক্ষ করা যায়। এই নৌপথে দক্ষিণ অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ যাতায়াত করে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে চলাচলে বিধিনিষেধ থাকলেও মানুষের মধ্যে তেমন সতর্কতা নেই।
প্রতিটি ফেরিতে যাত্রীদের ভিড় দেখা যায়। গায়ে গা ঘেঁষে, কেউ মাস্ক পরে, আবার কেউ মাস্ক ছাড়া পদ্মা পার হওয়ার জন্য ফেরিঘাটে আসেন। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা লক্ষ করা যায়নি।
শিমুলিয়া ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়াত আহম্মেদ বলেন, ঈদ সামনে রেখে ঘাটে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ প্রচণ্ড। যাত্রীদের কারণে ফেরিগুলোতে গাড়ি লোড করা যাচ্ছে না। ফেরিঘাটে এলেই যাত্রীরা তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। ১৩টি ফেরিতে যাত্রী ও যানবাহন পার হচ্ছে।
শিমুলিয়া ফেরিঘাটের ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) মো. হিলাল উদ্দিন বলেন, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার পর থেকে যানবাহনের চাপ বাড়তে শুরু করেছে। শুক্রবার সকাল থেকে সে চাপ আরো কয়েক গুণ যায়। শনিবার ও গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত চাপ ছিল। লঞ্চ ও স্পিডবোট বন্ধ থাকায় ফেরিতে যাত্রীরা পারাপার হয়েছেন।
শুধু ফেরি নয়, রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় অর্ধেক যাত্রী আর বর্ধিত ভাড়া নিয়ে যেসব গণপরিবহন চলছে সেখানেও শ্রমিক এবং যাত্রীরা খুব একটা মানছে না স্বাস্থ্যবিধি।
অনেক যাত্রী অভিযোগ, গণপরিবহন চলাচল শুরু হলেও যাত্রী ও গাড়ির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বাস চলাচল শুরু হওয়ায় যাত্রীরা অল্প খরচে গন্তব্যে যেতে পেরে খুশি।
সোমবার (১০ মে) দুপুরে কারওয়ানবাজার এলাকায় হাবিব রহমান নামে এক যাত্রী বলেন, গণপরিবহন চালু করায় আমরাদের মতো সাধারণ মানুষের একটু সুবিধা হয়েছে। এখন কম খরচেই যাতায়াত করা যাচ্ছে। তবে অনেকেই দেখলাম স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এক আসন ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও গাদাগাদি করে যাত্রীরা গন্তব্যে যাচ্ছেন।
কারো মুখে মাস্ক আছে, কারো নেই। এভাবে চলতে থাকলে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে।
কারওয়ানবাজারে আরো দেখা যায়, যাত্রীরা ঠেলাঠেলি করে উঠছেন বাসে। অনেক সময় কোনো সিট খালি রাখা হচ্ছে না। দাঁড়িয়েও যাচ্ছে লোকজন। কারো কারো মুখে নেই মাস্ক। সকালের দিকে বাসগুলো কিছুটা ফাঁকা থাকলেও বেলা বাড়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাসগুলোতে একই অবস্থা দেখা গেছে।
এ ছাড়া ডাবল সিটে নেওয়া হচ্ছে যাত্রী। বেশিরভাগ বাসে যাত্রী ওঠানোর সময় চোখে পড়েনি কোনো জীবাণুনাশক স্প্রে’র। তবে দুই একটি বাসে স্প্রে ছিটিয়ে যাত্রীদের বাসে ওঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি গাড়িতে সিট ভর্তি করে ওঠানো হয়েছে যাত্রী। এসব তদারকিরও যেন কেউ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেকড় পরিবহনের চালক শামিম হোসেন বলেন, এতক্ষণ মাস্ক পরেছিলাম। মাত্র একটু নাক থেকে নামিয়েছি। শ্বাস নিতে একটু সমস্যা হচ্ছিল তাই। আর সকালে বাস রাস্তায় নিয়ে নামার আগে পুরো বাসের সিটে জীবাণুনাশক স্প্রে করেছি। পাশাপাশি দুই সিটের একটিতে যাত্রী নিয়ে অন্যটি ফাঁকা রেখে বাস চালানো হচ্ছে। কেউ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন না। যাত্রীদের মাস্ক না থাকলে বাসে যাতায়াত করতে দিচ্ছি না।
এদিকে স্বাস্থ্যবিধি না মানার ক্ষেত্রে পরিবহন শ্রমিকদের জন্য এখনো কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা। বরং প্রাথমিক অবস্থায় তারা সকলকে সচেতন করার জন্যই কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে রাজধানীর কারওয়ানবাজার এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর বিপ্লব ভৌমিক বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য আমরা যাত্রী এবং পরিবহন সংশ্লিষ্ট সকলকেই সচেতন করছি। যাদের মাস্ক নেই, তাদের মাস্ক দিচ্ছি। তবে এখনো কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা তাদের এখন সচেতন করার চেষ্টা করছি। যদি তারা সচেতন না হন, তবে হয়তো আইনী দিকটি নিয়েই ভাবতে হবে।
মার্কেটেও নেই স্বাস্থ্যবিধি : ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে দোকানপাট-শপিংমলে ভিড় বাড়ায় উপেক্ষিত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি। বেশিরভাগ মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনাগুলো মানার ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন।
চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে দোকানপাট-শপিংমল খোলা থাকছে রাত ১০টা পর্যন্ত। দোকানপাট খুলে দেওয়ার পর মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে স্বাস্থ্য সচেতনতা কারোর মধ্যেই দেখা যায়নি।
ব্যবসায়ী ফিরোজ আলম সুমন বলছেন, আমরা চেষ্টা করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মার্কেটে আসতে। মার্কেটের সামনে মাস্ক পরে আসার জন্য ব্যানার দেওয়া হয়েছে পাশাপাশি মাইকিংও করা হচ্ছে।
রাজধানীর তালতলা, মৌচাক, বেইলি রোড, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, সব মার্কেটেই কমবেশি ক্রেতাদের ভিড় । আর এ ভিড়ে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না অনেকেই। এখনো বেশিরভাগ মার্কেটে নেই জীবাণুনাশক টানেল, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা মাস্ক পরিধানে তদারকির করার কোনো ব্যবস্থা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নিউমার্কেটের ভেতরে নিচতলায় ক্রেতাদের চাপ বেশি। ফলে একজন থেকে আরেকজনের নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দোকানগুলোতেও কোনো ধরনের ব্যারিকেড কিংবা পদচিহ্ন দিয়ে দূরত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়নি।
নিউমার্কেটে প্রবেশের ফটক মোট চারটি। চারটি ফটকেই জীবাণুনাশক স্প্রে করার অবকাঠামো আছে কিন্তু একটিও সচল নয়। একই অবস্থা তালতলা মার্কেটেও। আর মৌচাক মার্কেটের চারটি গেটের মধ্যে সামনের প্রধান গেটে শুধু জীবাণুনাশক টানেল লাগানো রয়েছে। তবে এর থেকে ভালো অবস্থা বেইলি রোডের শপিংমলগুলোর। সেখানে ট্যানেলের পাশাপাশি ক্রেতারা ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে তাপমাত্রা মাপার বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার স্প্রে করার ব্যবস্থা দেখা গেছে।
মাস্কও পরছে না কেউ : স্বাস্থ্যবিধি মানার সবচেয়ে যে প্রচার-প্রচারণা তার মধ্যে মাস্ক ব্যবহার করার জন্য বার বার বলা হচ্ছে। কিন্তু অনেকে এই মাস্কও ব্যবহার করছেন না। মার্কেট কিংবা গণপরিবহনে এ চিত্র দেখা গেছে।
রামপুরা বাজার এলাকায় দেখা যায়, শতকরা মাত্র ২০ শতাংশের লোক মাস্ক ব্যবহার করছেন। বাকি ৮০ ভাগ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন না। আবার অনেকে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করেনি।
আব্দুল হাকিম নামের ব্যক্তি জানালেন, মাস্ক পরলে তার শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। এ কারণে তিনি মাস্ত ব্যবহার করেন না। আবার মাস্ক ব্যবহার কনে করছেন না এমন প্রশ্নে কিছু ব্যক্তি করোনা রোগকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
এদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে ঘরমুখো মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
তিনি বলেছেন, যা ঘটছে, তার ফলাফল আগামী ১৪ দিন পরই পাওয়া যাবে। নিজেদের ঝুঁকি নিয়ে যারা ভিড়ে গেছেন, তারা যেন পরিণতির জন্য সরকারকে কোনোভাবে দায়ী না করেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ সতর্কবার্তা দেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি বুঝেই নিষেধাজ্ঞাসহ কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার। সবাই নিয়ম মানার কথা দিয়েও কথা রাখছে না। এত দেখেও শিখছে না মানুষ। বিষয়টি খুবই হতাশার।
মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী নানা সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে দোকান-গণপরিবহন খুলে দেওয়ার দাবি জানানো হয়। তারা সরকারকে কথাও দেন যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। কিন্তু খুলে দেওয়ার পরে আর কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি।
প্রতিদিন মার্কেটে ভিড়, ফুটপাতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কেনাকাটা করার চিত্র, গাদাগাদি করে মার্কহীন অবস্থায় ফেরি পার হয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। সেইসব ছবি দেখে হতাশাব্যক্ত করেন ফরহাদ হোসেন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, নিজেদের ভালো আমরা কেউ বুঝতে চাইলাম না। একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ানো আর শতভাগ ডাবল মাস্ক ব্যবহার করলেই সব স্বাভাবিক করে দেওয়া যেত। কিন্তু যা কিছুই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, মানুষ কোনোটিই মানেনি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :