• ঢাকা
  • শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১
বয়স থেমে থাকছে না মহামারী দীর্ঘ হওয়ায়

শঙ্কায় চাকরিপ্রত্যাশীরা


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ২০, ২০২১, ০৪:৫৬ পিএম
শঙ্কায় চাকরিপ্রত্যাশীরা

ঢাকা : দেড় বছর ধরে করোনা মহামারীতে আক্রান্ত সারা বিশ্ব। কবে এর শেষ হবে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারছে না বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানী।

প্রথম ঢেউয়ে নাকাল হয়ে পড়া বিশ্বের অনেক দেশ এখন ব্যস্ত করোনার দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ সামাল দিতে। মহামারীর কারণে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব।

বন্ধ রয়েছে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অসংখ্য কলকারখানা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের দেশে কিছু কিছু কলকারখানা ও অফিস চালু হলেও এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

প্লে গ্রুপের কোমলমতি শিশু থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-সবারই একটা প্রশ্ন, কবে আবার ক্লাস চালু হবে, আবার সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাব, পরীক্ষা দেব, পড়াশোনা শেষে চাকরিতে প্রবেশ করব।

মহামারীর শুরু থেকে অনলাইনের মাধ্যমে স্কুল শিক্ষার্থীদের পাঠাদানের চেষ্টা চললে বিপাকে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পাস করে বের হওয়ারা। সবারই একটা চিন্তা, মহামারী বছর পার করে ফেলেছে, আমাদের বয়স বাড়ছে, কবে চাকরি পাব? এভাবে চলতে থাকলে আদৌ চাকরিতে আবেদন করার বয়স থাকবে তো? মহমারীতে সব থেমে থাকলেও বয়স তো থামে না।

মহামারীর কারণে চাকরির বিজ্ঞপ্তি তেমন একটা আসছে না। দুয়েকটার দেখা মিললেও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বয়স বেশি হওয়ার কারণে আবেদন করতে পারছে না অনেক চাকরিপ্রত্যাশী। এ কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে তাদের মধ্যে। তরুণরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। করোনা মহামারীতে সেই দাবিটা আবারো জোরালো হয়ে উঠছে।

২০১৮ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা বাবুল আফ্রাদ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সরকারি চাকরির জন্য। তার কাছে এখন চাকরি

পাওয়ার চিন্তার চেয়েও বয়সসীমার দুশ্চিন্তা ভর করছে বেশি। তিনি বলেন, মহামারীতে সব স্থবির থাকলেও বয়স বেড়ে চলছে। গত কিছুদিন ধরে সার্কুলারও হচ্ছে না। মহামারীর আগে চাকরির বয়স হাতে ছিল ৩ বছর। পরীক্ষাগুলো দিতে পারলে এতদিনে হয়তো একটা চাকরি হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর দেড় বছর সময় আছে। এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। পরিবার তাকিয়ে আছে-লেখাপড়া শেষ করে কবে সংসারে ভূমিকা রাখব কিংবা নিজে সংসার করবে।

এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে অর্থনৈতিক সংকটও সামলাতে হচ্ছে। মাস্টার্সের পরে টিউশনি করে চলতাম। করোনায় সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। যে সময়টায় চাকরি করে বাবা-মাকে সাপোর্ট করার কথা, তখন ফ্যামিলি আমাদের বোঝা হিসেবে টানছে। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের প্রান্তসীমা ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে অন্তত ৩২ বছর করা উচিত।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা আরাফাত হোসেন সরকারি চাকরির আশা ছেড়ে তুলনামূলক কম বেতনের অন্য চাকরি খুঁজছেন। বয়স নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। বলেন, সেশন জটের কারণে চাকরির প্রতিযোগিতায় ঢুকতেই আমাদের অনেক বয়স হয়ে যায়। এর মধ্যে করোনা আরো সময় খেয়ে নিচ্ছে। যেগুলোতে আগে আবেদন করতাম না এখন তেমন চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখছি। সরকার যদি বয়সসীমার বিষয়টা ক্লিয়ার করতো তহালে আমাদের দোটানায় থাকতে হতো না। মন দিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারতাম।

চাকরির খোঁজে থাকা সদ্য সাবেক শিক্ষার্থীরা বলছেন, মহামারীকালে সরকারি ছাড়াও বেসরকারি খাতের নিয়োগের সংখ্যা কমে আসায় তারা কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পাচ্ছেন না। এমনকি রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর বড় একটি নিয়োগের পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় চাকরি প্রত্যাশীদের অনেকেই ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছেন। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু না হওয়ায় স্নাতক শেষ বর্ষে আটকে থাকা শিক্ষার্থীরা আবেদনই করতে পারছেন না। সে কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি জোরালো হচ্ছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘমেয়াদে বয়স বাড়ানোর পক্ষে নন। সংকট সমাধানে তারা সময়িকভাবে অল্প দিনের জন্য ছাড় দিতে বলছেন। মহামারীর কারণে গতবছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অনলাইনে ক্লাস হলেও পরীক্ষা নেওয়ার জটিলতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এক বছরের বেশি সময়ের জটে পড়েছেন।

এ বিষয়ে সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, এখন যেহেতু প্রতি বছর বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি আসছে, ফলে মহামারীর জটিলতায় বিসিএস চাকরিপ্রত্যাশীদের বেশি ক্ষতি হবে না। একজন শিক্ষার্থী অনার্স পরীক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষার যোগ্য হয়ে ওঠেন না। মহামারীর কারণে এটা তো বিশ্বব্যাপী একটা ক্ষতি। পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, মানুষের জীবনযাপনের ক্ষতি হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে কিছু ক্ষতি যে হচ্ছে, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এর সমাধান করে নিতে হবে।

পিএসসি প্রতি বছরই বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে। স্নাতক যারা সম্পন্ন করেছেন তারা সেটাতে আবেদন করতে পারছেন। এটি একটি ইতিবাচক দিক। যদি এমন হতো যে, পিএসসি বিজ্ঞপ্তিটা দুই-তিন বছর পরপর দিচ্ছে, তাহলে সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা ছিল। সাবেক এই শিক্ষা সচিব বলেন, যে বিজ্ঞপ্তিগুলো চলমান রয়েছে, এতে যারা আবেদন করেছেন তাদের বয়স নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। পরীক্ষা যখনই অনুষ্ঠিত হোক, তারা সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। করোনার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় অনেক পদ খালি হচ্ছে এ সময়টায়। ফলে পরবর্তীতে অনেক বেশি পদের বিজ্ঞপ্তি আসতে পারে। এর একটি সুবিধা চাকরিপ্রত্যাশীরা পাবেন বলে আশা করছি।

তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু ছাড় দেওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে বয়স বাড়ানোর পক্ষে নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল হক। বলেন, মহামারী কত বছর ধরে চলবে এটা কেউ জানে না। এটা একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এটা যদি ৫ বছর চলে তাহলে বয়স কী ৫ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হবে? এক বছরের জন্য সময় বাড়িয়ে দেওয়ার বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু লম্বা সময় করা মুশকিল। দেশে সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন। এর মধ্যে চার থেকে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী বিসিএস বা অন্যান্য চাকরির জন্য চেষ্টা করে। ৩৫ বছর পর্যন্ত যদি এসব শিক্ষার্থী বসে থাকে, তাহলে তারা এক পর্যায়ে পরিবার ও সমাজের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

যারা বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি করছে, তাদের জন্য সারা বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার পোস্ট রয়েছে। ফলে বয়সসীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও বাকিদের বাদ দিতেই হবে। তাই তাদের এত বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা না করে, অন্য কোনো কাজে জড়িত হওয়া উচিত।

চাকরির বয়সসীমা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ইউসুফ হারুন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।

উল্লেখ্য, গত বছর জুলাই মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে ১৮ লাখ ২১ হাজার ২৮৪টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ১৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ জন কর্মরত আছে, ফাঁকা আছে তিন লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ। ফাঁকা এসব পদের সংখ্যা, ওই সময়ের মোট পদের ২১ দশমিক ২৭ শতাংশ।  মহামারীর মধ্যে সেসব পদ পূরণের কাজটি থমকে গেছে। গত বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটির সময় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ ছিল। পরে কিছু প্রক্রিয়া শুরু হলেও সংখ্যায় তা সামান্য।

মহামারীর মধ্যেই গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ৪২তম এবং ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। আগামী ৬ আগস্ট ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বয়সের ক্ষেত্রে এক দফা ছাড় দেয় সরকার। তাতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ যারা ৩০ বছর পেরিয়ে গেছেন, তারাও চাকরির জন্য আবেদন করতে পেরেছেন। তারপর পেরিয়ে গেছে আরো আট মাস। সরকারের তরফ থেকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত এখনো না আসায় চাকরিপ্রত্যাশীদের উদ্বেগ বাড়ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!