• ঢাকা
  • বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১
সদরঘাটের কয়েকশ শ্রমিক ও হকার কর্মহীন

ক্ষুধা বোঝে না লকডাউন


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ৫, ২০২১, ১২:২৯ পিএম
ক্ষুধা বোঝে না লকডাউন

ঢাকা : ১৯৮৮ সালের কথা। সুদূর পটুয়াখালী থেকে কাজের সন্ধানে ঢাকা আসেন আলমগীর হোসেন। সেই থেকে সদরঘাট এলাকায় বেড়ে ওঠা। এই এলাকা ঘিরেই তার জীবন-জীবিকা। করোনা ঠেকাতে চলমান বিধিনিষিধের কারণে দুই সন্তানের বাবা আলমগীর এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। সে কথা বলতে গিয়ে বারবার গলা ধরে আসছিল তার।

আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘তিন যুগ ধরে ঢাকায় আছি। এত বিপদ সামলাইতে হয় নাই কখনো। রোজগার পুরোপুরি বন্ধ। এরশাদের সময় কারফিউতেও এত কষ্ট হয় নাই। ওই সময় একা ছিলাম। এখন বউ, দুই ছেলে আছে। নিজের পেটে দেওয়ার আগে পরিবারের চিন্তা করতে হয়।’

দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় সরকার সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া বিধিনিষেধ চলবে ৭ জুলাই পর্যন্ত।

কঠোর বিধিনিষেধের কারণে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন, নৌযান চলাচল। সরকারি-বেসরকারি অফিসও বন্ধ। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া বারণ। যৌক্তিক কারণ ছাড়া বের হলে গুনতে হচ্ছে জরিমানা। পেতে হচ্ছে শাস্তি। কঠোর বিধিনিষেধের কারণে মানুষের আনাগোনায় দিন রাত জেগে থাকা সদরঘাটে এখন সুনসান নীরবতা। পুরোপুরি কর্মহীন আলমগীরের মতো কয়েকশ শ্রমিক ও হকার। যাদের জীবিকা চলে সদরঘাটকে কেন্দ্র করে।

কথা বলে জানা যায়, আলমগীরের স্ত্রী গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর জৈনকাঠি এলাকায় থাকেন। দুই ছেলে সদরঘাট এলাকায় মাদরাসায় হেফজ বিভাগে পড়াশোনা করছে।

মাদরাসায় অনেকটা কম টাকায় সন্তানদের পড়াতে পারলেও লকডাউনের সময় কর্তৃপক্ষও বিপদে পড়েছেন। কিছুদিনের জন্য অন্যদের মতো তার সন্তানদেরও বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু লকডাউনে কীভাবে বাড়ি পাঠাবেন, সেই দুশ্চিন্তায় আর ছেলেদের নিয়ে আসেননি আলমগীর।

বলছিলেন সে কথা। হুজুররা বলছিল ওদের নিয়ে যেতে। কোথায় নিব লকডাউনে? বাড়ি পাঠালে গিয়ে খাবে কী? মাদরাসায় দুজনের জন্য সাত হাজার টাকার মতো খরচ হয়। বাড়িতে ১২ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। এখন না চাইলেও পরে তো ঠিকই কিস্তি দিতে হবে। এইসব চিন্তায় মাথা কাজ করে না।

কী কাজ করতেন এতদিন? এমন প্রশ্নে আলমগীর বলেন, ‘লঞ্চ চলার সময় যাত্রীদের মালামাল আনা-নেওয়া করে ভালোই আয় করতাম। মাঝেমধ্যে আম, বিভিন্ন ফল বেচতাম। এসব নিয়ে ভালোই ছিলাম। কিন্তু সব তো বন্ধ। ঈদের আগে লঞ্চ চালু হইবে কি না তাও জানি না।

সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আকুতি জানালেন এই শ্রমিক। বললেন, ‘অল্প কয়দিনের চাল-ডালের ব্যবস্থাও যদি সরকার করত, তাইলে কিছুডা চাপ কমত। ক্ষুধা তো লকডাউন, কড়াকড়ি বোঝে না। তিনবেলা কিছু না কিছু খাওয়া লাগে।’

হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়ায় করোনা আতঙ্কের পাশাপাশি জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। দিনে এনে দিনে খাওয়া শ্রমজীবী হাজার-হাজার মানুষ চোখে সর্ষে ফুল দেখার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। যতই লকডাউনের দিন সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ততই বাড়ছে এসব মানুষগুলোর অভাব ও শঙ্কা।

রাজধানীর কাওরান বাজার এলাকায় কয়েকটি বস্তিতে এমন কয়েকজন দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে কথা হয়। নসিমা নামের ভ্রাম্যমাণ ভাত বিক্রেতা জানান, আগে তিনি কাওরান বাজার এলাকায় দুপুরে ভাত বিক্রি করে সংসার চালাতেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে ৭ দিনের লকডাউন করে দেওয়ায় পুলিশ তার ভাতের দোকান থেমে থেমে বন্ধ করে দেয়। ফলে, তার এখন আর ক্রেতা নেই। দোকান বন্ধ রাখায় তার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ফ্লাক্সে করে চা-বিস্কুট বিক্রেতা ৬০ বৃদ্ধ হেদায়েত উল্লাহ জানান, আগে তিনি হাতিরঝিল এলাকায় ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করতেন। কিন্তু লকডাউন দেওয়ায় তিনি এখন আর ব্যবসা করতে পারছেন না। তিনি বলেন, আগে হাতিরঝিলে অনেক মানুষ ঘুরতে আসতো। কিন্তু এখন খালি থাকে। আমার বউ ও ২টা মেয়ে আছে। ছেলেরা বিয়ে করে নিজের সংসার চালাইতে হিমশিম খায়। আমরা অনেক কষ্টে আছি। আমাদের জন্য কিছু করেন। আমরা আর পারতেছি নাহ।

মাসুম নামে এক রাজমিস্ত্রি জানান, লকডাউনের আগে থেকেই কাজ কম ছিল। কোনো মতে খেয়ে জীবন চালাচ্ছিলাম। এখন এমন সময় কাজ বন্ধ থাকায় গ্রামে মা-বাবার জন্য কিছুই পাঠাতে পারি না। জীবন-জীবিকার ওপর বিরক্ত এই অসহায় রাজমিস্ত্রির কাছে লকডাউনের সামনের দিনগুলো কেমন কাটবে জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কাজ নেই, তাই আয়ও নেই। আয় নেই, তাই ঠিকমতো খাবারও জোটে না। এরমধ্যে সামনের দিনগুলো নিয়ে তো বিরাট চিন্তায় আছি।

সালমা নামের ফুটপাতে মাস্ক বিক্রেতা এক নারী জানান, আগে অনেক মাস্ক বিক্রি করতাম। কিন্তু লকডাউনের কারণে মাস্ক বিক্রিও বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষজন রাস্তায় নাই তেমন। তাই আমার মাস্ক কেনার লোকও খুঁজে পাই না। বাচ্চার খাবার কেনা অনেক কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ঘুরে দেখা যায়, চা দোকানি, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, হকার, রডমিস্ত্রি, সুপারভাইজার, টেকনিশিয়ান, হেলপার কিংবা শাটার মিস্ত্রিরা অধিকাংশই অস্থায়ী ও দিনের চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করেন বলে তাদের অনেকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ হারিয়ে বেহাল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তারা বলছেন এখন আর কেউ কোনো সহায়তাও করছে না। আগের মতো কেউ কোনো ত্রাণও দিচ্ছে না। এজন্য তারা চান আবার যেন স্বাভাবিক হয়ে যায় সব কিছু।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!