ঢাকা : দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার আরোপিত চলমান কঠোর বিধিনিষেধ ঈদুল আজহা উপলক্ষে শিথিল করা হলেও আগামী ২৩ জুলাই থেকে ফের ১৪ দিনের কঠোর ‘লকডাউন’ শুরু হবে। এই দুই সপ্তাহ গার্মেন্টসসহ সব ধরনের শিল্পকারখানাও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ীরা।
এরই মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএসহ পাঁচটি সংগঠন ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে শিল্পকারখানা খোলা রাখার আবেদন করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেয় গত বৃহস্পতিবার। শিল্পকারখানা খোলা রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) পক্ষ থেকেও। তবে এবারের লকডাউনে কারখানা খোলা না থাকারই সম্ভাবনা বেশি।
এর আগে লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ে। বন্ধ হতে থাকে কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান। কর্ম হারিয়ে বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় কোটিতে। এর প্রভাব পড়ে দেশের তৈরি পোশাক খাতে। হাজার হাজার কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়। প্রায় দেড় বছরের ক্ষতি কাটিয়ে এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তৈরি পোশাক খাত। এখন আবারও বিশ্বের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ফিরতে শুরু করেছে। অর্ডার হচ্ছে পণ্যের, শিপমেন্ট হচ্ছে নিয়মিত। যদিও কন্টেইনার সংকট এখনো রয়ে গেছে। এ অবস্থায় কারখানা বন্ধ হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে পোশাক খাত, ফিরে যেতে পারেন বিদেশি ক্রেতারা।
কারখানা খোলা রাখতে চেয়ে এফবিসিসিআই আবেদন জানিয়েছে সরকারের কাছে। এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘উৎপাদন বন্ধ থাকলে আমদানিকৃত কাঁচামাল অব্যবহৃত হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে আমদানিকারক ও উৎপাদক উভয়েই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এছাড়া ক্ষুদ্র ও ছোট কারখানাগুলো বন্ধ রাখা হলে উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং কারখানাগুলো পুনরায় চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এ অবস্থায় ইতিমধ্যে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ টেরি-টাওয়েল ম্যানু. অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ রপ্তানি ও উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনগুলো ও চেম্বারগুলো শিল্প-কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এফবিসিসিআইয়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।’
শনিবার (১৭ জুলাই) চুয়াডাঙ্গায় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এবারের লকডাউন হবে সবচেয়ে কঠোর লকডাউন। খুবই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে সবকিছু। সে লক্ষ্যে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। লকডাউন ঠিকঠাক পালিত হলে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’ তার এই ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
পোশাক খাতের মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। সারা দেশের মানুষের ভালোর জন্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে তাকে সাপোর্ট করবে বিজিএমইএ। তবুও এ সময়টা গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করছি সরকার আমাদের কথা বিবেচনা করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা ইতিমধ্যেই সরকারকে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি।’
সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে এখনো কিছু জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল) আমাদেরকে মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত জানানোর কথা। এখন পর্যন্ত আমাদেরকে কিছু জানানো হয়নি। আমরা আশাবাদী সরকার আমাদের কথাগুলো বিবেচনা করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’
ফারুক হাসান আরও বলেন, ‘গত দেড় বছরে ব্যাপক ক্ষতি হয় গার্মেন্টস শিল্পে। সে ক্ষতি একটু একটু করে কাটিয়ে উঠছিলাম আমরা। ইতিমধ্যে অনেক গার্মেন্টস ক্ষতির বোঝায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পিক টাইমে যদি আবার লকডাউন দেওয়া হয় তবে আবারও বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি হবে তৈরি পোশাক খাত।’
এ প্রসঙ্গে নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি ফজলে এহসান শামীম বলেন, ‘লকডাউনে কারখানা বন্ধ রাখলে আমরা সঠিক সময়ে অর্ডার ডেলিভারি করতে পারব না। এতে করে বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। যেমনটা হয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে। আমরা তবুও সরকারের সব সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তকে আমরা বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর। সরকার যদি মনে করে এতে করে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে তবে স্যাক্রিফাইস করেই আমরা কারখানা বন্ধ রাখব। এতে ক্ষতি হলেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের পাশে থাকব আমরা।’
শিল্পকারখানা বন্ধ থাকলে আসন্ন ঈদে কোরবানি হওয়া পশুর চামড়া নিয়েও বিপাকে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। চামড়াশিল্প মালিকদের দুশ্চিন্তার কারণ হলো ২৩ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হলে তারা সারা দেশ থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে কারখানা পর্যন্ত নিয়ে আসার বিষয়টি কীভাবে নেবেন?
কারণ ওইদিন থেকে সব ধরনের শিল্পকারখানা ও যানবাহন বন্ধের কঠোর বার্তা দিয়ে রেখেছে সরকার। এ অবস্থায় চামড়ার দাম নির্ধারণ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে শিল্পমালিকরা এই শিল্পকে কঠোর বিধিনিষেধের বাইরে রাখার দাবি জানালেও সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।
এদিকে ঈদের আর মাত্র দুই দিন বাকি থাকলেও অনেক কারখানার কর্মীরা এখনো পায়নি বেতন। বেতন হলেও বোনাস হয়নি অনেক কারখানায়।
শিল্প পুলিশের তথ্যানুযায়ী আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনায় প্রায় ৩ হাজার ১০০ পোশাক ও বস্ত্র কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সদস্য। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিজিএমইএর ৩৪৬, বিকেএমইএর ১৫২ ও বিটিএমএর ৮১ কারখানা শ্রমিকদের গত জুন মাসের বেতন-ভাতা দেয়নি।
অন্যদিকে ঈদ-বোনাস দেয়নি বিজিএমইএর ১ হাজার ৩৮২, বিকেএমইএর ৪৯৫ ও বিটিএমএর ২৪২টি কারখানা। বেপজার অধীনে থাকা ইপিজেডের ২৮টি কারখানা বেতন-ভাতা দেয়নি। আর বোনাস পরিশোধ করেনি ২৪১টি কারখানা।
পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পকারখানাও তদারক করে শিল্প পুলিশ। তাদের তথ্যানুযায়ী আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনায় পোশাক এবং বস্ত্রসহ মোট কারখানা আছে ৭ হাজার ৮২৪টি। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জুন মাসের বেতন দেয়নি ১ হাজার ৫৩৯টি। আর বোনাস দেয়নি ৫ হাজার ৮৭৩ কারখানা। অর্থাৎ ৮০ শতাংশ কারখানা বেতন দিলেও বোনাস দিয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। শুধু বৃহস্পতিবার ৫২৭টি কারখানা বেতন ও ৭১৭টি কারখানা বোনাস দিয়েছে।
বেতন-বোনাস পরিশোধ করা প্রসঙ্গে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘ইতিমধ্যে পোশাকশিল্প মালিকদের সঙ্গে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিম কাজ করছে। আশা করছি ঈদের আগেই বেতন-বোনাস পরিশোধ করে দিবে।’
আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে সারা দেশে সর্বাত্মক কঠোর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে আট দিনের জন্য। ঈদে যেন মানুষ বাড়িতে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে তার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম। ইতিমধ্যে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ।
বাস-ট্রেন-লঞ্চে মানুষ গাদাগাদি করে যাচ্ছে গ্রামে। এভাবে মানুষের ঈদ যাত্রায় করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ হবে বলে ধারণা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ঈদের পরে আবারও ঢাকায় ফিরে আসার জন্য একদিন সময় দেওয়ায় এ অবস্থা তখনো থাকবে বলে মনে করছেন তারা।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :