ঢাকা : ঈদ উপলক্ষে ৮দিনের শিথিল বিধিনিষেধের পর শুরু হয়েছে শুক্রবার থেকে আবারো ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন। আর এই লকডাউনের শুরুতেই গতকাল সকালে রাজধানীতে পৌঁছে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। ভোগান্তির সাথে গুনতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। সেইসাথে পরিবার নিয়ে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে তাদের পৌঁছাতে হয়েছে গন্তব্যে।
এরআগে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেলেন, এবার বিধিনিষেধ গতবারের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর হবে। সংবাদ মাধ্যম তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে কঠিন হবে এই বিধিনিষেধ। এটি বাস্তবায়ন করতে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। লকডাউন চলাকালে অফিস-আদালত, গার্মেন্টস-কলকারখানা সবকিছুই বন্ধ থাকবে। এদিকে ঈদের ছুটি শেষে শুরু হওয়া লকডাউনে গতকাল সকাল ৬টা থেকে বন্ধ হয়ে যায় বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন। রিকশা চলাচলও ছিল কম। এতে আগের রাতে রওনা হয়ে সকালে রাজধানীতে পৌঁছানো লোকজন পড়েন বিপাকে। গাড়ি না পেয়ে মাথায়, হাতে ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরতে হয় তাদের। শিশুসন্তান, নারী, বয়স্কদের নিয়ে দীর্ঘপথ হেঁটে বাসার দিকে যান অনেকে। কেউ আবার অ্যাম্বুলেন্স, ভ্যান বা পিকভ্যানে রওনা হন গন্তব্যে। তবে সব ক্ষেত্রেই তাদের মোটা অঙ্কের ভাড়া গুনতে হয়েছে।
অন্যদিকে চেকপোস্টের কারণে অধিকাংশ যাত্রীই আমিনবাজার ব্রিজ থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে হেঁটে যেতে দেখা গেছে। রামপুরা-বাড্ডা সড়কে অনেক মানুষকে হেঁটে বাসায় ফিরতে দেখা যায়। আর রামপুরায় দেখা যায় পুলিশের চেকপোস্টে দীর্ঘ লাইন। সকালে যারা নৌপথে সদরঘাট পৌঁছেছেন, বিপাকে পড়েন তারাও।
যানবাহন বন্ধ থাকায় সদরঘাট থেকেও পায়ে হেঁটে গন্তব্যে ফিরেন কর্মজীবী মানুষ। শুক্রবার রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, মৎস্য ভবন মোড়, শাহবাগ, সাইন্সল্যাব মোড় ঘুরে দেখা যায়, শত শত মানুষ হেঁটে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছেন। তারা সদরঘাট থেকে আসছেন। কয়েকজনকে রিকশা বা ভ্যানেও আসতে দেখা গেছে। অনেকে ব্যাগ মাথায় নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কঠোর বিধিনিষেধে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয় এমন পরিস্থিতির।
ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে কোনোমতে একটি রিকশা ভ্যানে উঠেন পটুয়াখালী থেকে আসা ফরিদা আখতার, যাবেন মালিবাগের চৌধুরীপাড়ায়। বিরক্তির সঙ্গে তিনি বললেন, এমন হইলে কালকে লঞ্চ ছাড়ল কেন? আমরা কীভাবে যাব? জায়গায় জায়গায় পুলিশ আটকাইতেছে। কোনো কিছু শুনতে চায় না তারা।
সদরঘাট থেকে আসা মেহেদী নামে এক যুবক বলেন, আজ থেকে কোনো গাড়ি চলবে না, সেটা জেনেই এসেছি। এখন বাধ্য হয়ে ব্যাগ মাথায় নিয়ে হেঁটে বাসায় যেতে হচ্ছে।
গণপরিবহন বন্ধ থাকায় মোটা অঙ্কের রিকশা ভাড়া গুনতে হয়েছে অনেক। মিলন নামের এক যাত্রী জানান, সকাল ৮টায় সদরঘাটে লঞ্চ থামে। সেখান থেকে তার পরিবারের চার সদস্য মিলে দুটি রিকশা নিয়ে প্রথমে সদরঘাট কোর্টকাচারি আসেন। সেখান থেকে পাঁচটি ধাপে মিরপুর পৌঁছান। প্রত্যেকবারই ভাড়া লেগেছে তিন থেকে চারগুণ। এভাবে সদরঘাট থেকে মিরপুর ১০ নম্বরে পৌঁছাতে তার ৩ হাজার টাকা চলে গেছে উল্লেখ করে বলেন, আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে মিরপুর ১০ নম্বর পৌঁছানোর পর দেখেন তার পকেট ফাঁকা। তাই লাগেজ টেনে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে পায়ে হেঁটে ১১ নম্বরে যাচ্ছেন।
ভোলা থেকে লঞ্চে করে সকালে সদরঘাট নামেন আমজাদ আলী। শিশুসহ পরিবার নিয়ে যাবেন গাজীপুর। সন্তান কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করেন তিনি। আমজাদ জানান, সকালে সদরঘাট পৌঁছেছেন। ঢাকা এসে বিপদে পড়েছেন। বাসা গাজীপুর। গাড়ি পাচ্ছেন না। তাই হেঁটেই গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
এদিকে ঢাকায় ফিরে গাড়ি না পেয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ভোলা থেকে আসা ফারুক হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, দেশের প্রয়োজনে লকডাউন দিচ্ছে সরকার। নিশ্চয়ই এটা আমাদের ভালোর জন্য। আসলে সিস্টেমটা হওয়া উচিত ছিল পজিটিভলি। আমার অফিস খোলা। কোম্পানি আমাকে ছুটি দিচ্ছে না। চাকরি চলে যাবে, আমি যদি ঢাকায় না আসি। আমাকে তো অফিসে আসতেই হবে। যদি সাধারণ সিটি থেকে সবকিছু বন্ধ করে দিত তাহলে আমরা আসতে পারতাম না।
রিপন মন্ডল নামে আরেক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা তো আরামে আছেন। আমরা যারা খেটে খাওয়া মানুষ, আমরা আছি বিপাকে। আমরা তো কেউ ঢাকায় পিকনিক করতে আসি নাই। যা করবে একটা নিয়মের মধ্যে রেখে করা উচিত।
এদিকে কঠোর লকডউনের শুরুতেই গতকাল রাজধানীতে কঠোর অবস্থানে ছিল পুলিশ। গণপরিবহন ঢুকলেই নেওয়া হয়েছে আইনি ব্যবস্থা। রাসেল স্কয়ার মোড়ের পুলিশ চেকপোস্টে হানিফ, শ্যামলী, এম. ট্রাভেল ও দেওয়ানসহ বেশকয়েকটি বাসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। প্রতিটি বাসকে ২ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
এ প্রসঙ্গে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, শুক্রবার সকাল থেকে বিধিনিষেধ শুরু হবে এটা তারা জানেন। সেই অনুযায়ী রওনাও দেন তারা। কিন্তু পথে প্রচণ্ড যানজটে পড়ায় ঢাকায় ঢুকতে তাদের বিলম্ব হয়ে যায়। শ্যামলী পরিবহনের সুপারভাইজার শাওন বলেন, কুড়িগ্রাম থেকে তারা ঢাকায় আসেন। সায়দাবাদ বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি পার্কিং করার কথা থাকলেও রাস্তায় জ্যাম থাকায় আসতে দেরি হয়ে গেছে। তাই পুলিশ মামলা দিয়েছে।
রাজধানীর প্রবেশ পথ আমিনবাজার ব্রিজেও চেকপোস্ট বসায় পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এখানে প্রতিটি গাড়ি ও যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকা মেট্রেপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এ কারণে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট।
পুলিশ বলেছে, চেকপোস্টে যেসব যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছে না, সেগুলোকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চেকপোস্টের কারণে অধিকাংশ যাত্রীকেই আমিনবাজার ব্রিজ থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।
ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এ এস এম মাহতাব উদ্দিন বলেন, অনেক যানবাহনই ঢাকায় প্রবেশ করতে পারেনি। আমরা গাড়িগুলো থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। যদি বিধিনিষেধের মধ্যে পড়ে, তো ছেড়ে দিয়েছি। যে যানবাহনের যাত্রীরা সন্তুোষজনক উত্তর দিতে পারছেন না, তাদের ঘুরিয়ে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জের পথে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ডিসি মাহতাব আরো বলেন, যখন দূরপাল্লার বাসগুলো রওনা দিয়েছিল তখন বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু ঢাকায় প্রবেশের আগেই তারা বিধিনিষেধের আওতায় পড়ে গেছে। তাই যাত্রীদের নামিয়ে বাসগুলো টার্মিনালে ঢোকার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সকাল থেকে বসে চেকপোস্ট। ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করতেও দেখা গেছে অনেককে। একটু পর পর টহল দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বাহিনীর গাড়ি।
নিউ মার্কেট থানার পরিদর্শক মো. মনিরুল হক ডাবলু বলেন, আমরা পুরো এলাকা সিলগালা করে দিয়েছি। সকালে ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন এমন দুই একজনকে মানবিক দিক বিবেচনায় রিকশায় চলাচল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এই এলাকায় কোনো রিকশাও চলতে দেওয়া হয়নি। বিধিনিষেধ না মেনে বাইরে বের হওয়ায় ঢাকার বাবুবাজার সেতু এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করা হয় অনেককে।
তবে কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিন সকালে রাজধানীর সড়কে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের ভিড় দেখা গেলেও দুপুর নাগাদ এ ভিড় কমতে শুরু করে। লকডাউন ছাড়াও শুক্রবার ছুটির দিন ও ঈদের তৃতীয় দিন হওয়ায় ঘরে অনেকেই সময় পার করছেন স্বজনদের সঙ্গে। প্রধান সড়কে ভিড় না থাকলেও গলির রাস্তায় এখনো জটলা বেঁধে আছে। অনেক এলাকার গলির ভেতর চায়ের দোকান খোলা দেখা যায়। সেখানে সাধারণ মানুষকে আড্ডাও দিতে দেখা গেছে।
এর আগে গত ঈদুল আজহা উদযাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদ পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে গত ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত বিধিনিষেধ শিথিল করেছিল সরকার। যদিও লকডাউন শিথিল করার সরকারি সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। তাদের মতে, কোভিড-১৯ মহামারির গত দেড় বছরে এখনই সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে লকডাউন শুরুর প্রথমদিন রাজধানীর প্রায় সব দোকানপাটই বন্ধ ছিল। জরুরি সেবার দপ্তর বাদে অফিস-আদালত আর শিল্পকারখানাও বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কোরবানির পশুর চামড়া সংশ্লিষ্ট খাত, খাদ্যপণ্য এবং কোভিড-১৯ প্রতিরোধে পণ্য ও ওষুধ উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিধিনিষেধের আওতায় বাইরে থাকছে। পাশাপাশি আগামীকাল রোববার থেকে সীমিত পরিসরে চলবে ব্যাংকিং কার্যক্রম।
ভাইরাসটির ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে গত এপ্রিল থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল। মে মাসে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জুলাই মাসে এসে আগের সব রেকর্ড ভাঙছে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :