ঢাকা : আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মূল্যায়নে সম্প্রতি উঠে এসেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিত্র।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত এক দশকে রপ্তানি ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
আর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বলছে, ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতি বা জিডিপির আকার বেড়ে ৫০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে।
এ ছাড়া এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, শিল্পখাতে শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের কারণে চলতি অর্থবছরে (২০২১-২০২২) দেশে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
যদিও অর্থনীতিবিদদের প্রত্যাশা, এসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে অর্থনীতির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, বাংলাদেশ তার চেয়ে আরো বেশি ভালো করবে।
তারা বলছেন, বিশ্বব্যাংক ও এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আর্থিক সংস্থাগুলো সাধারণত সরকারের টার্গেটের চেয়েও জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম নির্ধারণ করে থাকে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবার তা সংশোধন করা হয়ে থাকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরকার চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ শুরুতে (গত জুনে) বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনে সেই পরিসংখ্যানটি সংশোধন করে ১ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধির ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে নতুন করে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, রপ্তানি পুনরুদ্ধার ও খরচ বাড়তে থাকার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
সংস্থাটি প্রতিবেদনে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ধীরে ধীরে বেগবান হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। তবে এই বেগ বৃদ্ধির বিষয়টি টিকা দেওয়ার গতির ওপর নির্ভর করছে বলেও জানায় তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, টিকার সরবরাহ বাড়লে এবং মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার গতি পাবে।
অন্যদিকে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, শিল্পকারখানা ও রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়ানোয় সরকারের প্রাক্কলিত ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভবপর হবে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত মোকাবিলা করেও বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল।
এর মধ্যে শিল্পকারখানা ও রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়ানোয় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছে ৭ শতাংশের বেশি। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বিবেচনায় নিয়ে এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও মনে করে, বাংলাদেশ এই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।
বিজ্ঞপ্তিতে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ বলেন, জীবিকা রক্ষায় জীবন বাঁচানোর জন্য সরকারের নীতিগুলো বাংলাদেশের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে, যা সাম্প্রতিক কঠিন সময়ে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি।
বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, উদ্দীপক ব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির দক্ষ বাস্তবায়ন বাংলাদেশের এ অবস্থায় টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।
তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা, দ্রুত ভ্যাকসিন দেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উন্নতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত এক দশকে রপ্তানি ওপর ভর করে চাঙা অর্থনীতির দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
এতে বলা হয়, গত এক দশকে ডলারের হিসাবে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানির মাধ্যমে এই সাফল্য এসেছে। আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বৃহত্তর সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও জোরদার হবে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের নিবন্ধে বাংলাদেশকে বহুপাক্ষিক ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, আসিয়ান, রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) কিংবা কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ ট্রান্স-প্যাসেফিক পার্টনারশিপের (সিপিটিপিপি) সঙ্গে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে পূর্বমুখী সহযোগিতার সম্পর্ক আরও ফলপ্রসূ হবে।
এ ছাড়া গত ৭ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক-এডিবি এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছে বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। অনলাইনে বাংলাদেশ নিয়ে গ্লোবাল রিসার্চ ব্রিফিংয়ের (২০২১) আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। এতে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা অংশ নেন। সেখানে করোনা সংকটে বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিভিন্ন সম্ভাবনা ও সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর ওই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি বা জিডিপির আকার বেড়ে ৫০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৬০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
তবে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, করোনা সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুরোপুরি পুনরুদ্ধার নির্ভর করছে টিকা দেয়ার গতির ওপর। যদি ২০২২ সালের জুন মাস নাগাদ ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়া যায়, তাহলে প্রবৃদ্ধি ফের আগের জায়গায় ফিরে আসবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :