ঢাকা : নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের বিষয়ে সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই আইন আর করেনি কোনো সরকারই। তাই পাঁচ বছর পরপর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় এলেই আলোচনায় আসে বিষয়টি।
পর পর তিনটি ইসি গঠনের সময়কালে এই আইন প্রণয়নের বিষয়টি নিয়ে জোরালো আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো সরকারই হাঁটেনি আইন প্রণয়নের পথে। এবারও নতুন ইসি গঠনের আগে হচ্ছে না এ সংক্রান্ত আইন।
বিগত দুবারের ধারাবাহিকতায় সরকার সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন ইসি গঠনের দিকে এগুচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে এটা জানানও দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি ২০১২ সাল থেকে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করছেন। তার আগেও ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গঠন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন। আর এ নিয়ে সুশীল সমাজ থেকে একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে বারবার। তবে সে দাবি উড়িয়ে না দিলেও রাজনৈতিক দলগুলো কখনো জোর আওয়াজও তোলেনি।
বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। সেখানে ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।
একাধিক নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া নির্বাচন কমিশন গঠিত হইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাহার সভাপতিরূপে কার্য করিবেন। এই সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে কোনো নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ তাঁহার কার্যভার গ্রহণের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসরকাল হইবে।
তবে সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও গত পাঁচ দশকে কোনো সরকারই সে পথে হাঁটেনি। বিগত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি এককভাবে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়ে এলেও ২০১২ সাল থেকে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সম্ভাব্যদের নাম নিয়ে তাদের মধ্য থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন করছেন।
অবশ্য সর্বশেষ দুটি ইসি গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করে তাদের থেকেও নামের তালিকা সংগ্রহ করেছেন। জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকেই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইনের বিষয়টি সামনে আসে।
ওই সময় বিদায়ী এটিএম শামসুল হুদা কমিশন ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ পদ্ধতি) আইন, ২০১১ শিরোনামে’ আইনের খসড়াও প্রণয়ন করেছিল। তবে, সরকার আইন না করে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে নতুন কমিশন গঠন করে।
ওই সময় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ বেশ কয়েকটি দল সংবিধানের বিধান উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতির কাছে ইসি নিয়োগে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই সময় সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও ইসি গঠনের আইন করার প্রস্তাব আসে।
এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে নতুন ইসি গঠনের আগেও রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে আইন প্রণয়নের ওপর চাপ আসে। গতবার সুশীল সমাজের নেতারাও সার্চ কমিটির সঙ্গে আলাপকালে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওই সময় ইসি গঠনে আইন চেয়ে অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ উচ্চ আদালতে একটি রিটও করেন।
অবশ্য আদালত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করলেও এরইমধ্যে নতুন কমিশন নিয়োগ দেয় সরকার। পরে ওই নিয়োগের বিরুদ্ধে পৃথক রিট দায়ের হলে তা খারিজ করে দেন আদালত।
এদিকে নতুন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার দিন ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের কথা বলেছিলেন।
ওইদিন সংসদের প্রশ্নোত্তরে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরীর প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা চাই পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হোক।
সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে এখন থেকেই সে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।’ অবশ্য এরপর বিগত ৫ বছরে ইসি নিয়োগে আইন প্রণয়নে সরকার বা ইসির কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
এদিকে এবার আবার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় এলে আইনের বিষয়টি সামনে আসে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের পাশাপাশি সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ইসি নিয়োগে আইনের দাবি তুলেছে। অবশ্য দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ইসি গঠনে আইনের বিষয়ে জোরালো করে কিছু বলেনি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ‘আইন কে পাস করবে’ সেই প্রশ্ন তুলেছেন। এই সংসদের সব সদস্যই আওয়ামী লীগের বলে তিনি উল্লেখ করে ওই প্রশ্ন তোলেন।
যদিও বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা গত ৬ সেপ্টেম্বর সংসদে ইসি গঠন প্রসঙ্গে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ নিয়ে তিনটা অপশনের একটা হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে এরকম আর কোনো অপশন রাখা হয়নি। এখানে আইন প্রণয়ন বাধ্যতামূলক। এখানে আইন ছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।
ইসি গঠনে আইন চেয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর দেশের ৫২ বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ‘আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে’ নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই এমন একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সরকারের নির্দেশক্রমে আইন মন্ত্রণালয় একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করবে বলে বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয়।
সর্বশেষ ৪ অক্টোবর ইসি গঠনে আইন চেয়ে ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠকেরও আয়োজন করা হয়। ওই গোলটেবিলে তারা আইন প্রণয়নের যৌক্তিকতা তুলে ধরার পাশাপাশি সুজন নির্বাচন কমিশন নিয়োগে একটি প্রস্তাবিত আইনের খসড়া উপস্থাপন করে।
সবার মতামত নিয়ে তা চূড়ান্ত করে নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে উপস্থাপন করার কথাও জানান। ইসি গঠন বিষয়ে আইন প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আইনের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে, তবে এই অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো করা সম্ভব হবে না। লং টার্মে (দীর্ঘমেয়াদে) নিশ্চয়ই আইন করা হবে।’
এবিষয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শেষ সময়ে এসেই আইনের কথা বলি, বিষয়টি তা নয়। আমরা সব সময়ই এটা বলে আসছি। আর এখনো আইন প্রণয়নের অনেক সময় হাতে আছে। নতুন ইসি গঠনে এখনো হাতে চার মাসের বেশি সময় আছে।
আমাদের দেশে ৫ মিনিটে আইন প্রণয়ন করতে দেখেছি। সরকারের আন্তরিকতা থাকলে যে সময় রয়েছে তার মধ্যে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সুন্দর আইন করা সম্ভব। তবে, আমাদের মনে হয় সরকার সেটা করবে না। কারণ, তারা অনুগতদের দিয়ে সার্চ কমিটি করে। আরেক অনুগতদেরই কমিশনে বসাবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :