ঢাকা : রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের পিয়ন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে গাড়ি চালানোর অভিযোগ ওপেন সিক্রেট হলেও কখনোই নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। এমনকি এদের কাছে অসহায় ট্রাফিক পুলিশও। বিষয়টি অকপটে স্বীকারও করেছেন দুই মেয়রসহ পুলিশও।
সাম্প্রতিক সময়ে ময়লার গাড়ি চাপায় দুই জনের মৃত্যুর ঘটনায় এসব চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
গত দুই দিনের ব্যবধানে দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী ও দৈনিক প্রথম আলোর সাবেক একজন কর্মী নিহত হয়েছেন। এই দুটি গাড়ির চালকদের কেউই প্রকৃত চালক না। শুধু এই দুটি ময়লার গাড়িই নয়, সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ ময়লার গাড়ির চালকই এদের মতো।
আর যাদের নামে গাড়ি বরাদ্দ সেসব চালকদের কেউ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের গাড়ি চালান না, গাড়ি চালায় বাইরের লোক। তেল চুরি করে টাকা আত্মসাৎ করাই এসব তথাকথিত চালকদের ‘বেতন’।
পরিবহন চালকদের দুই সিটিতে দুটি সংগঠন রয়েছে। ড্রাইভার্স ইউনিয়ন নামে সংগঠন দুটির বিশাল কমিটি রয়েছে। তাদের নেতারা কবে যে গাড়ি চালিয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। প্রভাব খাটিয়ে ভাড়াটে চালক দিয়েই নিজের নামের গাড়িগুলো পরিচালনা করছেন। আর এসব কারণেই পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানান।
তিনি বলেন, জড়িত চালকদের গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং কথিত ওয়ার্কশপের সহকারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। এ সুবাদে সিটি করপোরেশনের চালকদের সঙ্গে তাদের সখ্য হয়। সখ্যের কারণে তারা ময়লাবাহী গাড়ি চালানোর সুযোগ পায়। এজন্য তাদের কোনো বেতন ছিল না, প্রতিদিন গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত তেল থেকে ১৭-২০ লিটার তেল বিক্রি করাই ছিল তাদের উপার্জন।
গ্রেপ্তার হানিফকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, তিনি গত ৬-৭ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্কশপে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ডিএনসিসির বেতনভুক্ত বা দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারীও না। গত কয়েক বছরে সিটি করপোরেশনের কয়েকজনের সঙ্গে তার সখ্য হয়। সেই সখ্য থেকেই গাড়ি চালানোর সুযোগ পেয়ে যান তিনি। এজন্য তিনি কোনো মাসিক বা দৈনিক হাজিরার বেতন পেতেন না। তবে গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত তেল থেকে প্রতিদিন ১৭-২০ লিটার তেল বাঁচাতে সক্ষম হতেন। সেই তেল বিক্রির অর্থই ছিল তার আয়ের উৎস।
লাইসেন্স ছাড়া সিটি করপোরেশনের চালকরা কীভাবে গাড়ি চালান, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশ সেগুলো চেক করে কি না, সেটি নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাফিকের একজন কর্মকর্তা বলেন, দিনের বেলা সিটি করপোরেশনের একটি ট্রাক বেপরোয়া গতিতে ইউটার্ন নিচ্ছিল, চালকের কানে ছিল মোবাইল। গাড়িটি আমি আটকাই এবং কাগজ যাচাই করি। কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি চালক। তার গাড়ি আটকানোর পর আমি বিপদে পড়ি। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে একের পর এক কল। সঙ্গে যুক্ত হয় আমাদের কর্মকর্তাদের কল। তারাও ছেড়ে দিতে বলেন। কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই আমাকে ছাড়তে হয়।
এই কর্মকর্তা বলেন, আমি আমার স্যারদের বলে চালককে এক ঘণ্টা বসিয়ে কাউন্সেলিং করাই। এতে আরো হিতে বিপরীত হলো। সকালে অফিসে এসে দেখি আমার অফিসের সামনে ময়লা ফেলে গেছে সিটি করপোরেশনের গাড়ি। যে ময়লা সারা দিনেও তাদের ফোনের পর ফোন দিয়ে সরানো সম্ভব হয়নি।
সিটি করপোরেশনের গাড়ি বা চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়টা অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ বলে দাবি করেন এক ট্রাফিক কর্মকর্তা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িগুলো সেভাবে চেক করা হয় না বলে জানান তিনি। চেক করা বা ব্যবস্থা নেওয়া হলে ওপর থেকে প্রচুর চাপ আসার কথা স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।
তবে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর করপোরেশনের গাড়ি অন্যায় করলে কোনো ধরনের ছাড় না দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান রমনা ট্রাফিক জোনের সহকারী কমিশনার মো. রেফাতুল ইসলাম। তিনি বলেন, কাউকে কোনো ছাড় না দিয়ে যিনি আইন অমান্য করবেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের সে ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। সেভাবেই আমরা কাজ করছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অবৈধ চালক দিয়ে গাড়ি পরিচালনার দায় সিটি করপোরেশন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। এর সঙ্গে সংস্থার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারাই জড়িত। এছাড়া পরিবহনের তেল চুরির ভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও পান। এসব ঘটনায় যে গাড়ি চালিয়েছে বা গাড়িতে যে ছিল শুধু তাকে শাস্তি দিলে অন্যায় হবে। তাদের হাতে যারা গাড়ি তুলে দিয়েছে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সিটি করপোরেশনও বলছে, গাড়িগুলো অবৈধভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা বরাদ্দ নিয়েছেন শুধু তাদের শাস্তির আওতায় আনা হলেও যারা বরাদ্দ দিয়েছেন তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেন, বিষয়টা শর্ষের মধ্যে ভূতের মতো অবস্থা। যারা অঘটন ঘটান, তারা যেভাবে দায়ী, এর বাইরে যারা এসব বিষয় তদারকিতে থাকেন, তাদেরও গাফিলতি রয়েছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো উচিত বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব।
তিনি বলেন, বর্জ্য আনা-নেওয়ায় ব্যবহূত গাড়িগুলো অত্যন্ত আধুনিক। জাপান সরকারের দেওয়া। কোনো ধরনের কারিগরি জ্ঞান ছাড়া অদক্ষ লোক দিয়ে সেগুলো চালানো হচ্ছে। দিনে গাড়ি চলার কথা না, সেটাও চলছে। আইন না মেলে হরহামেশাই উল্টো পথে যাচ্ছে এবং দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুরো ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে দক্ষ জনবল দিয়ে এই ব্যবস্থাপনা করা উচিত। যাতে করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়।
জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নিজস্ব গাড়ি রয়েছে ৫৯১টি। কিন্তু চালক রয়েছে ২২৫ জন। এর মধ্যে ভারী যানবাহন রয়েছে ৩৩৭টি। কিন্তু তার চালক আছে ১১০ জন। এর মধ্যে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে চালক রয়েছে ২৬ জন। বাকি গাড়িগুলো সিটি করপোরেশন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই পরিচ্ছন্নতা ও মশককর্মীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের। তাদের বর্জ্যবাহী ভারী যানবাহন রয়েছে ১৩৭টি। বিপরীতে চালক আছে মাত্র ৪১ জন। এর মধ্যে আবার ২৫ জনই দৈনিক মজুরিভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। এছাড়া চালকের পাশাপাশি সংস্থা দুটির ৮০ ভাগ যানবাহনের ফিটনেস সনদও নেই।
২০১৬ সালে চূড়ান্ত করা দুই সিটির অর্গানোগ্রামে গাড়ি ৩০৬টি করে চালকের পদ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ২১৫টি ভারী যানচালক ও ৯১ জন হালকা যানচালক। অথচ করপোরেশনের প্রয়োজন এর দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু সিটি করপোরেশন চাইলেই এর চেয়ে বেশি যানচালক নিয়োগ দিতে পারে না। ফলে অতিরিক্ত গাড়ি চালানোর জন্য দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কিংবা ভাড়াটে চালক নিয়োগ দিতে হচ্ছে।
এদিকে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর ভারী চালক খুঁজেও পাচ্ছে না সিটি করপোরেশন। ৫০ জন ভারী যানবাহন চালক নিয়োগ দেওয়ার জন্য গত ২৯ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু এতে আবেদন করেছে মাত্র ৪১ জন। লাইসেন্সগুলো বিআরটিএতে পাঠলে দেখা যায়, এ থেকে মাত্র ১৯ জনের লাইসেন্স ঠিক। বাকিগুলো জাল।
উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের চালকের অনেক সংকট রয়েছে। আমরা ৪৫টি ভারী ও ৪৭টি হালকা গাড়ি চালকের চাহিদা চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা ৪৫ জনের অনুমতি পেয়েছি। নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের চালকদের অর্ধেকের মতো বৈধ না। অন্য বিভাগ থেকে এনে তাদের দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। এর মধ্যেও নিজের গাড়ি অন্যকে দিয়ে চালাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমাদের কোনো না কোনো আইনের আওতায় থাকতে হয়। নীতিমালা মেনে চলতে হয়। সেই নিয়মকানুন মেনেই চালকের গাড়ি চালানোর দায়িত্ব ছিল। সে সেই দায়িত্ব পালন করেনি। আরেকজনকে ভাড়া দিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। সুতরাং সবাইকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে। যার দায়িত্ব ছিল তাকে আমরা সাময়িক বরখাস্ত করেছি। চাকরি থেকে অপসারণ করবো। যে চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় ছিল সে খুনি। তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবো। কোনো বহিরাগত যেন ডিএসসিসির গাড়ি চালাতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেবো।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :