• ঢাকা
  • শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আজ বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের ৫০তম প্রয়াণ দিবস


চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ১৪, ২০২১, ০২:৫৬ পিএম
আজ বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের ৫০তম প্রয়াণ দিবস

ছবি : বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরেরর ৫০তম শাহাদাতবার্ষিকী আজ ১৪ ডিসেম্বর। তার শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর পাদদেশ রেহাইচরে শাহাদাতবরণের স্থানে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ও শিবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।

জেলা প্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধ সংসদ কমান্ড, বীর মুক্তিযোদ্ধারা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ ছাড়া দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে জেলা প্রশাসন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাকিউল ইসলাম জানান, সকালে পুষ্পস্তবক ছাড়াও নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্ধ্যায় একই স্থানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নাটিকা প্রদর্শনী করা হবে।

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি মুক্তিবাহিনীর ৭ নং সেক্টরের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। মহানন্দা নদীর তীরে শত্রুর প্রতিরক্ষা ভাঙার প্রচেষ্টার সময় তিনি শহীদ হন। তার উদ্যোগে মুক্তিবাহিনী ওই অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ফলে মুক্তিবাহিনী প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে এবং ওই অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করে। তার সম্মানে ঢাকা সেনানিবাসের প্রধান ফটকের নাম ‘শহীদ জাহাঙ্গীর গেট’ নামকরণ করা হয়েছে।

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার ছিলেন কৃষক এবং মা সাফিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। মহিউদ্দিনরা তিন বোন তিন ভাই। দাদা আব্দুর রহিম হাওলাদার ছিলেন প্রতাপশালী ব্যক্তি। পিতার আর্থিক দৈন্যতার কারণে মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে মামার বাড়ি মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে যান জাহাঙ্গীর। পাতারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৫৩ সালে তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। মুলাদি মাহমুদ জান পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬৬ তে তিনি বরিশাল বিএম (ব্রজমোহন) কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বিমানবাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করেন, কিন্তু চোখের অসুবিধা থাকায় ব্যর্থ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালের ২ জুন তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন লাভ করেন। সেনাবাহিনীতে তার নম্বর ছিল পিএসএস-১০৪৩৯। তিনি মিলিটারি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং, রিসালপুর থেকে অফিসার বেসিক কোর্স-২৯ এবং ইনফ্যান্ট্রি স্কুল অব ট্যাকটিক্স থেকে অফিসার উইপন কোর্স সম্পন্ন করেন। সর্বশেষ ১৯৬৯ সালে আগস্ট মাসের শেষের দিকে এক মাসের ছুটিতে দেশে ফেরেন।

১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নে ‘পাকিস্তান-চীন সংযোগকারী মহাসড়ক' নির্মাণে কর্তব্যরত ছিলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি ছুটে এসেছিলেন পাকিস্তানের দুর্গম এলাকা অতিক্রম করে সঙ্গে মাত্র একটি পিস্তল নিয়ে। ১০ জুন তিনি কয়েক দিনের ছুটি নেন এবং ফিরে পশ্চিম পাকিস্তানের রিসালপুর যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও সীমান্তরক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেন।

প্রথমেই গেলেন নিকটবর্তী বিএসএফের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে। সেখান থেকে দিল্লি, এরপর কলকাতা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চারজন বাঙালি সামরিক অফিসার পালিয়ে এসেছেন শুনে বাঙালি, মুক্তিবাহিনী ও বাঙালি শরণার্থীদের প্রাণে বিপুল উৎসাহ জাগল। মুক্তিযুদ্ধের চিফ কমান্ডার কর্নেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কলকাতায় এলেন এই পাঁচ বীরকে অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্য। ভারত থেকে পরে তিনি বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছান। তবে পাকিস্তানে আটকে পড়া আরও তিনজন অফিসারসহ তিনি পালিয়ে যান ও পরে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মেহদিপুরে মুক্তিবাহিনীর ৭ নং সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন ৩ জুলাই। তিনি সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাদের আক্রমণ এত প্রবল ও ত্রাস সৃষ্টিকারী ছিল যে একবার একটি শত্রু লাইনের ওপর হামলা চালানোর আগমুহূর্তে প্রায় সহস্রাধিক শত্রুসেনা প্রাণের ভয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ ছেড়ে চলে যায়। 

বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর কারণে তাকে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শহরটি দখলের জন্য সেক্টর কমান্ডার এ এন এম নূরুজ্জামান তিনটি দল গঠন করেন। প্রথম দলের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা গিয়াসকে। দ্বিতীয় দলের দায়িত্ব দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা রশিদকে। তৃতীয় দলের দায়িত্ব পান মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন। ১১ ডিসেম্বর সেখানে ভারতীয় বাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। পরবর্তী দুই দিন ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর একাধিকবার ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই শত্রুদের অবস্থানে আক্রমণ করবেন এবং তিনি সেটিই করেন।

১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বারঘরিয়া এলাকা থেকে ৩-৪ টি দেশি নৌকায় করে রেহাইচর এলাকা থেকে মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন। নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটি একটি করে প্রত্যেকটি শত্রু অবস্থানের দখল নিয়ে দক্ষিণে এগোতে থাকেন। তিনি এমনভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন যেন উত্তর দিক থেকে শত্রু নিপাত করার সময় দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু কোনো কিছু আঁচ করতে না পারে। এভাবে এগোতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত, তখন ঘটে বিপর্যয়।

হঠাৎ বাঁধের ওপর থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ৮ থেকে ১০ জন সৈনিক দৌড়ে চর এলাকায় এসে যোগ দেয়। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর অবিরাম ধারায় গুলিবর্ষণ। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর জীবনের পরোয়া না করে সামনে এগিয়ে যান। যখন আর একটি মাত্র শত্রু অবস্থান বাকি রইল, এমন সময় মুখোমুখি সংঘর্ষে বাঙ্কার চার্জে শত্রুর বুলেটে এসে বিদ্ধ হয় জাহাঙ্গীরের কপালে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বিজয় সুনিশ্চিত করেই তিনি শহীদ হয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে এনে সমাহিত করা হয়। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে ৭ নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

বরিশালের নিজ গ্রামের নাম তার পরিবার ও গ্রামবাসীর ইচ্ছা অনুসারে তার ইউনিয়নের নাম ‘আগরপুর’ পরিবর্তন করে ‘মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর’ ইউনিয়ন করা হয়েছে। সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে বরিশাল জেলা পরিষদ ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের দান করা ৪০ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মাণ করছে বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের স্বরূপনগরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজের নাম তার নামানুসারে রাখা হয়েছে। ঝালকাঠি জেলা স্টেডিয়ামের নামও নামকরণ হয় বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের নামে।

সোনালীনিউজ/এসএন

Wordbridge School
Link copied!