• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী

জাতীয় জীবনের এক অনিন্দ্যসুন্দরক্ষণ


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ১৬, ২০২১, ০১:৩৩ পিএম
জাতীয় জীবনের এক অনিন্দ্যসুন্দরক্ষণ

ফাইল ছবি

ঢাকা : পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়ানোর মতো অপারগতা আর নেই। নিজের ওপর খবরদারি করবে আর একজন, নিজের উৎপাদন ভোগ করবে অন্য কেউ, নিজেকে থাকতে হবে অনুগত দাস হয়ে—এই অন্যায় কার্যকলাপ আর যাই হোক সচেতন এবং যুক্তিবাদী মানুষ মানতে পারে না। আর তাই শুরু হলো দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম। চলল ২৩ বছর। অবশেষে বাঙালির দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধে অর্জিত হলো বিজয়। এলো শোষণ-বঞ্চনাহীন কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।

আজ ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ উদ্যাপন করতে যাচ্ছে বিজয়ের স্বাধীনতার ৫০ বছর। সেইসঙ্গে রাজনীতির এই মহানায়কেরও একশত বছর পূর্ণ হলো। দুটো সৌভাগ্য নিয়ে ২০২১ সালটি ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে। এর আগেও ৫০ বছর ধরে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালিত হয়েছে, মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে, উচ্চারিত হয়েছে বীরত্বগাথা, দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ বছরই বাংলাদেশ মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সঙ্গে করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের বার্তা নিয়ে উদ্যাপন করতে যাচ্ছে তার বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাস প্রায় সকলেই জানেন; যদিও স্বাধীনতার ইতিহাসকে সংকুচিত করা হয়েছে অনেক বছর। সেটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ২১ বছর। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এমনই দাপট যা ধ্বংস করা যায় না। কেননা সেই স্বপ্ন বাংলার প্রত্যেক মানুষেরই স্বপ্ন। তাঁর সেই ভাবনা বাংলার আপামর জনসাধারণকে ঘিরে। স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় সংবিধান উপহার দিলেন, যেটি পাকিস্তান প্রস্তুত করতে সময় নিয়েছিল প্রায় নয় বছর, তারপরও সেটি ছিল অপূর্ণ। সেই সংবিধানে মানুষ ছিল না, মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কোনো প্রতিফলন ছিল না। বাংলাদেশ পারল জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নকে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর সুনিপুণ নেতৃত্বে এটি করা সম্ভব হয়েছিল। সংবিধানে জাতীয় চার নীতি লিপিবদ্ধ করা হলো, যে চার নীতির কাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলো। রক্ত দিতে দ্বিধা করল না বাংলার বীরেরা, সম্ভ্রম দিতে প্রস্তুত থাকল মায়েরা-বোনেরা, জন্মভূমি ছেড়ে শরণার্থী হওয়ার মতো ত্যাগ স্বীকার করল কোটি কোটি মানুষ। সেই আকাঙ্ক্ষাকে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হলো। বিশ্বের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অর্গানাইজেশনের সদস্যপদ লাভ করলেন। এবার শুরু হলো দেশ গঠনের কাজ।

সদ্য স্বাধীন একটি দেশে যেখানে রাস্তাঘাট নেই, অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক, যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশৃঙ্খলা, খাদ্যসংকট সেই দেশটিকে পুনরায় নতুন করে গঠন করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ইনটেলেক্ট মানুষজনকে দায়িত্ব দিলেন, সঙ্গে ডাকলেন। দেশে ফিরে যেমন বলেছিলেন, এখন একটিই কাজ দেশটিকে গঠন করা। বাংলার মানুষের খাদ্য ও বস্ত্রের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। এই কাজগুলো কারো একার নয়; সম্মিলিত, সকলের। শুরুও হয়েছিল। তিন বছরের মাথায় দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন যেন টনক নড়ল স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের, যারা মূলত এই ভূখণ্ডের কোনো উন্নতি দেখতে চায় না, বরং দেখতে ভালোবাসে অধীনস্থ থাকতে; তাদের ষড়যন্ত্রের বলি হলেন—শেখ মুজিব তথা বাংলাদেশ। কিন্তু সব মহলের বিভ্রান্তি আর জল্পনাকল্পনা অসার বা ভ্রান্ত প্রমাণ করে বাংলাদেশ ২০২০-২০২১ সালে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ তথা মুজিববর্ষ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করছে। একইসঙ্গে ২৬ মার্চসহ ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ উদ্যাপিত হচ্ছে বিজয়ের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছর। বাঙালির জাতীয় জীবনে এ এক অনিন্দ্যসুন্দরক্ষণ। জাতির পিতার কন্যা ও তার আদর্শের উত্তরাধিকারী জনগণনায়কোচিত নেতা শেখ হাসিনার সুযোগ্য, দৃঢ়, বিচক্ষণ ও সৃষ্টিশীল নেতৃত্বে বিগত এক দশকেরও অধিক সময় ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সমগ্র বিশ্বের জন্য এক বিরল বিস্ময়। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশসমূহের জন্য ‘রোল মডেল’। অনুসরণযোগ্য। আদর্শ।

বাংলাদেশ আজ অনেক ক্ষেত্রে, যেমন—দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলা, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্ম সেতু নির্মাণের সামর্থ্যে, কোভিড-১৯ বা করোনা প্যান্ডামিক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা ও নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যূনতম সময়ের মধ্যে অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে জনগণের জন্য ভ্যাকসিনেশনের ব্যবস্থা প্রভৃতিতে অনেক উন্নত দেশের জন্যও অনুকরণীয় ও ঈর্ষণীয় বিষয়। কিন্তু তারপরও নারীর প্রতি সহিংসতা, মাদক, পরিবেশদূষণ, নাগরিকসেবা এবং সর্বোপরি দুর্নীতির মোহগ্রস্ততায় এখনো আমরা হোঁচট খাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ আশাবাদ জাগালেও তা সর্বত্র বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠছে না।

এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা, সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। তবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক নানা সেক্টরে আপাত উন্নয়ন করলেও এর সামাজিক নানা সূচকে লক্ষ্যপূরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এই বাধা আমাদের অভ্যন্তরীণ সমাজকাঠামোর ভেতরেই বিদ্যমান, যেমন—বেকারত্ব। এটি একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধক নিঃসন্দেহে। সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস একে আরও প্রকট করে তুলেছে। দেশে বর্তমানে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরিচ্যুতও হয়েছেন অনেকে। এখন আমাদের সেদিকেই বেশি দৃষ্টি দেওয়া উচিত হবে। নতুবা উন্নয়নের মহাসড়কে যে অগ্রযাত্রা তা লক্ষ্যপূরণে হোঁচট খাবে বলেই মনে করি। এই দুঃসময়ে তৃণমূল মানুষের চাহিদা মেটাতে সরকার থেকে যে অনুদান দেওয়া হয়েছিল, আমরা দেখেছি সেগুলো কীভাবে লোপাট হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের যোগসাজশে সরকারের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সাজাও হয়েছে। কিন্তু সেটাই তো সব নয়, প্রয়োজন জাতিগত শুদ্ধি। আর এজন্য প্রয়োজন সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লাগামহীন বাজার দরের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনগুলোর বেপরোয়া সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক কেউই নিরাপদ নয়। বুয়েটের আবরার হত্যা কিংবা শিক্ষককে পানিতে চুবিয়ে আহত করার খবর আমরা ভুলিনি। এসব ঘটনা বিশ্বের বুকে আমাদের স্বজাতীয়বোধকে শুধু খর্বই করেনি, অপরাধীও করে তোলে। উপরন্তু দেশের প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতির মহোৎসব আমাদের সামগ্রিক উন্নয়কে করছে বাধাগ্রস্ত। এর বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণে বাধ্য হয়েছেন। তবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে দেশে দেশে সব রাজনৈতিক দল একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। সম্ভাবনা থাকে একনায়কতন্ত্র আচরণ কায়েমের। নিকট অতীতে আমাদের পার্শ্ববর্তী দুই রাষ্ট্র ভারতীয় কংগ্রেস ও পাকিস্তান পিপিলস পার্টির ক্ষেত্রে আমরা তা লক্ষ করেছি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ৩২ বছর ক্ষমতায় থাকা বামদল সিপিএম-এর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। সুতরাং কার্যকর বিরোধী দলহীন বর্তমান আওয়ামী সরকারেও স্বৈরাচার একদর্শী নীতি কোনোভাবে ঘটুক তা জনগণ আশা করে না। কিন্তু সরকারকে ঠিক পথে রাখার দায়িত্ব যে সুশীলসমাজের, তারা আজ নীরব কেন?

এখন সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মানুষের বাক্শক্তি ডাকাতি হয়েছে। তার বড় প্রমাণ ত্রুটিপূর্ণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর তাই তো গণমাধ্যমকেও এখন তার মেরুদণ্ডকে বন্ধক রাখতে হচ্ছে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধু ভোটের জন্য জনগণের কাছে গেলে চলবে না, বরং সাধারণ মানুষের সমস্যার কথাও বলতে হবে। সুশীলসমাজ সেই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে পারছে না। আমরা মনে করি, সর্বত্র রাজনীতিকীকরণ এ ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। সুশীলসমাজকে দলের বা ব্যক্তি বিশেষের না হয়ে রাষ্ট্রের জন্য কথা বলতে হবে। সেই পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেখানে আমরা ব্যর্থ হলে আমাদের সব উন্নয়নই মুখ থুবড়ে পড়বে। এ কথা সত্য, উন্নয়নের সব সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে, আর সব সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত চার দশকে অর্থনীতিসহ উন্নতির সব সূচকে পৃথিবীর পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক ও সামাজিক অগ্রগতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বের ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৬তম এবং উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার তালিকায় বাংলাদেশ ১১তম। স্যানিটেশন, মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও সেবা, প্রযুক্তির সাথে তরুণ প্রজন্মের মেলবন্ধন, খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা, মৎস্য উৎপাদন, ইলিশ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পোশাক রপ্তানি প্রভৃতি খাতে বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে অনুসরণীয়। একে বেগবান করতেই সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমাদের মনোযোগী হতে হবে। এই দুইয়ের অভাব সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতীয়মান হওয়ায় তারা আমাদের গণতন্ত্রের সম্মেলন থেকে বঞ্চিত করেছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের তার দেশে নিষিদ্ধ করেছে। এসব অনেক গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ। তথাপি সেই জাল ছিন্ন করে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের উদাহরণ আমাদেরই স্থাপন করতে হবে। নতুবা বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসেও স্বাধীন দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গীকৃত শহীদদের কাছে আমরা অপরাধী থেকে যাব।

স্বীকার করি, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে মানুষকে ভালোবেসে, দেশকে ভালোবেসে বর্তমান সরকার স্বাধীনতার ৫০ বছরকে গুরুত্ববহ করে তুলেছে। যদিও আমাদের কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে, তবে আমাদের যে উন্নতি সেটি সেইসব ব্যর্থতাকে ম্লান করে দেবে। ক্রমাগত যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে সেটি দেশকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশে রূপান্তর করবে এই বিশ্বাস রাখি। সকলকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!