• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

টিকার অজুহাতে উপেক্ষিত মাস্ক


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২, ২০২২, ০৯:৩২ এএম
টিকার অজুহাতে উপেক্ষিত মাস্ক

ঢাকা : দেশজুড়ে চলছে করোনার চতুর্থ ঢেউ। আর এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার একদিন আগেই সরকার আবার ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতিসহ ছয়দফা স্বাস্থ্য নির্দেশনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারো সরকারের সতর্কতায় ভ্রূক্ষেপ নেই সাধারণ মানুষের। রাস্তা-ঘাট বা জনবহুল স্থানে মাস্ক ব্যবহার করছেন কমসংখ্যক মানুষই। তাদের দাবি, টিকা নেয়ার কারণে মাস্ক ব্যবহারের খুব একটা প্রয়োজন নেই।

এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নির্দেশনা দিলেই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে না। এই নীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনকে মাঠে থাকতে হবে। গত ১৬ জুন থেকে প্রতি দিনই পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার টানা ১৪ দিন ৫ শতাংশের বেশি হওয়ায় গত বুধবার বাংলাদেশের করোনার চতুর্থ ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

চতুর্থ ঢেউয়ের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার আগের দিন আগের দিন গত মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়, তাতে ধর্মীয় প্রার্থনার স্থান, শপিং মল, বাজার, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক না পরলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তবে গতকাল বৃহস্পতিবারও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি। নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাউকে মাঠেই পাওয়া যায়নি। যদিও প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনা যতটা প্রাণঘাতী ছিল, তৃতীয় ঢেউয়ে ছিল না ততটা। চতুর্থ ঢেউ যেদিন নিশ্চিত হয়, সেদিনসহ পরপর চার দিন রোগী পাওয়া গেছে দুই হাজারের বেশি। তবে এই রোগীদের মধ্যে জটিলতা কম। হাসপাতালে চাপ কম, রোগীর মৃত্যুও প্রথম তিন ঢেউয়ের তুলনায় অনেক কম।

চতুর্থ ঢেউ নিশ্চিত হওয়ার দিন দুই হাজারের বেশি মানুষের দেহে করোনা শনাক্ত হলেও ২৪ ঘণ্টায় শূন্য মৃত্যুর স্বস্তিদায়ক তথ্যও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে জনগণের এমন উদাসীনতা চলতে থাকলে করোনা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত করোনায় ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ২ হাজার ১৮৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ সময় দেশে ১৩ হাজার ৯০৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ৭০। আগের দিন এ হার ছিল ১৫ দশমিক ২৩।

করোনায় যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে দুজন চট্টগ্রামের। আর ঢাকা ও রাজশাহীর ছিলেন একজন করে। চারজনের মধ্যে তিনজন পুরুষ, একজন নারী। দুজনের মৃত্যু হয়েছে সরকারি হাসপাতালে, দুজনের বেসরকারি হাসপাতালে।

এছাড়া যে ২ হাজার ১৮৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে ১ হাজার ৮৬৯ জন ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা। এর মধ্যে ১ হাজার ৭২৭ জনই মহানগরসহ ঢাকা জেলার। বাকি বিভাগগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৫৬, বরিশালে ৪৯, রাজশাহীতে ৪২, ময়মনসিংহে ২৬, খুলনায় ২৩, সিলেটে ১৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

করোনার উর্ধ্বগতির মধ্যেও রাজধানীর শাহবাগ মোড় ও বাংলামোটরসহ বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মানুষ দেখা গেছে, যাদের কারো মাস্ক ছিল না। শাহবাগ মোড়ে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন শফিকুল ইসলাম নামে এক পথযাত্রী। মাস্ক না পরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই ডোজ টিকা নিয়েছি। এখন আর মাস্ক পরে কি হবে? টিকা নেওয়ার পরও অনেকের আক্রান্ত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের প্রধান ফটকে কথা হয় চিকিৎসা নিতে আসা মধ্যবয়সী আরিফ হাসানের সঙ্গে। মাস্ক না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা এই ব্যক্তি বলেন, আমি তো টিকা নিছি। মাস্ক পরলে দম আটকায়, তাই পরতে পারি না।

নিউ ইস্কাটনে প্রভাতী উচ্চ বিদ্যানিকেতন ও ইস্পাহানি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঘুরে ছাত্রীদের মাস্ক দেখা যায়নি বললেই চলে। ইস্পাহানির দশম শ্রেণির ছাত্রী তাহমিনা বিনতে রশিদ বলে, এখন তো করোনা কমে গেছে। আর আমার করোনার টিকাও দেয়া হয়েছে, তাই মাস্ক তেমন একটা পরা হয় না।

বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ও ইস্টার্ন প্লাজাসহ কয়েকটি মার্কেটে সরেজমিনে দেখা যায়, এই বিপনীবিতানগুলোতে কেনাকাটা করতে আসা বেশিরভাগ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। কোনো রকম স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই তারা অবাধে ঘোরাফেরা করছেন।

বাংলামোটর মোড়ে আব্দুল গাফফার নামে এক তরুণ মাস্ক না পরার বিষয়ে বলেন, আমি অতো মানুষের ভিড়ে যাই না। জরুরি কাজে বের হয়েছিলাম। মাস্ক পরা হয়নি তবে পরা দরকার ছিল।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘বাহন পরিবহনে’ উঠে দেখা যায় অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। এ বিষয়ে কাউকে চিন্তিতও দেখা গেল না। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে একজন যাত্রী বলেন, ‘এমনি’। করোনা বাড়ছে বলার পর তিনি বলেন, মাস্ক পরলে গরম লাগে। এটুকু বলেই মুখ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নিলেন।

একটি পরিবহন সার্ভিসের টিকিট কালেক্টর মোহাম্মদ তাওহীদ বলেন, মানুষ বেশির ভাগই তো দেখি মাস্ক পরে না। তাওহীদ নিজেও মাস্ক পরেননি। বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, আমার মাস্ক পরার সময় নাই। আগে কাজ করতে হবে।

করোনা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা থেকে বাঁচতে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার একটি নির্দেশনা দিয়েছে, তবে তার বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। নো মাস্ক, নো সার্ভিস নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকাকে উদ্যোগী হতে হবে। একই সঙ্গে জনগণকে সচেতন হতে হবে।

জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেনের ধারণা করোনার চতুর্থ ঢেউ এবার বেশিদিন স্থায়ী হবে না। ওমিক্রনের যে সংক্রমণ আমরা দেখেছি, সেটা দ্রুত সময়ের মধ্যে সংক্রমণ চূড়ায় উঠে আবার দ্রুত নেমে গেছে। করোনার চতুর্থ ঢেউয়ে ওমিক্রনের যে দুটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, এটি আরও দ্রুত সংক্রমিত করতে সক্ষম। আমার ধারণা, এই হার জুলাইয়ের মধ্যে নেমে যাবে।

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। একই বছরের মার্চে ডেল্টা ধরনের করোনায় আসে দ্বিতীয় ঢেউ। এ পর্যায়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয় গত জুলাইয়ে। একপর্যায়ে শনাক্তের হার ৩৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার পর দেশে তৃতীয় ঢেউ নিয়ে আসে করোনার আরেক ধরন ওমিক্রন। তৃতীয় ঢেউয়ের সময় ২৮ জানুয়ারি করোনা শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ দাঁড়ায়, যা দেশে করোনা সংক্রমণ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। তবে তৃতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত বেশি হলেও মৃত্যু ছিল তুলনামূলক কম। এই ঢেউ দ্রুত নিয়ন্ত্রণেও আসে। গত ১১ মার্চ তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।

তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর মাস্ক পরা ছাড়া করোনাসংক্রান্ত সব বিধিনিষেধ তুলে দেয়া হয়। তবে জনগণের মধ্যে মাস্ক পরা নিয়ে অনীহার বিষয়টি আবার দেখা যায়।

করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ১৯ লাখ ৭৩ হাজার ৭৮৫ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৯ লাখ ৭ হাজার ৫০৯ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ১৪৯ জনের।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!