ঢাকা : ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে সরকার। সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষ কর চাপিয়ে দিয়েছে। এটা ভয়ংকর বৈষম্যমূলক, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। এতে ধনীর কিছু হবে না, গরিব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এছাড়া মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়বে জীবনযাত্রায়। এর বড় ধাক্কা আসবে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিবদের ওপর। গতকাল বুধবার ‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি : এখন এড়ানো যেত কি’ শীর্ষক সিপিডির আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন, সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান এবং যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরীসহ আরো অনেকে।
জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে সিপিডির নিবন্ধে বলা হয়, জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানোর ঘটনা দেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে অর্থনীতি এখন চরম চাপে। ধাপে ধাপে নানাভাবে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন সময় এ মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। সবচেয়ে বেশি ভুগবে নিম্ন আয়ের ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ। বাজারে সব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। দেশে কৃষি উৎপাদন কমলে আমদানি বাড়বে। শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হলে রপ্তানি কমবে।
এছাড়া গত মে পর্যন্ত শেষ আট অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। সরকার জ্বালানি তেলে প্রায় ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর নেয়। বিপিসির কাছ থেকে প্রতিবছর লভ্যাংশ নিচ্ছে। উদ্বৃত্ত অর্থ হিসাবে বিপিসির তহবিল থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনা মহামারির প্রভাবে অনেক মানুষ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে অনেকে। তাদের স্বস্তি না দিয়ে উল্টো চাপ তৈরি করা হচ্ছে। জ্বালানি খাতের সংস্থাগুলোর দুর্নীতি-অপচয় বন্ধ করতে না পেরে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি তেলের কর প্রত্যাহার বা কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো যেত। কিন্তু এটি এনবিআরের রাজস্বের বড় উৎস, তারা ছাড় দেবে না। ড. ফাহমিদা খাতুন আরো বলেন, জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমছে অথচ আমাদের দেশে বৃদ্ধি করা হলো। কেউ বলছে আমাদের দেশ থেকে নাকি অন্য দেশে কম। আপনারা দেখতে পারেন নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোথাও তেলের দাম বাড়তি নেই।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়বে জীবনযাত্রায়। এর বড় ধাক্কা আসবে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিবদের ওপর। সঞ্চয় ভেঙে খাবে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে সুদের হার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ এখান থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
ভিয়েতনাম উদীয়মান অর্থনীতির একটা দেশ, অথচ দেখেন ভিয়েতনামে ডিজেলের লিটার প্রতি দাম ৯৭ দশমিক ৯ টাকা। আমরা কার সঙ্গে কী তুলনা করছি? আমরা বলছি হংকংয়ে নাকি জ্বালানি তেলের দাম আরও বেশি। এটা ঠিক আছে। কিন্তু হংকং এ মাথাপিছু আয় ৪৯ হাজার ৬৬০ মার্কিন ডলার। আমাদের ২ হাজার ৫০৩ মার্কিন ডলার। সুতরাং কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করতে হলে মাথাপিছু আয়ও দেখতে হবে।
গত সাত বছরে (২০১৫-২১) বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা লাভ করেছে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে নিয়েছে। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা গেলো কোথায় বলে প্রশ্ন রেখেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি আরো বলেন, ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিপিসির পুরাতন হিসাবের খতিয়ান জানতে চাই। ২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ৯ হাজার ৪০ কেটি, ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি ও ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। এছাড়া ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭৬৮ টাকা, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৬৭ কোটি এবং ২০২১ সালে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা লাভ করেছে। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য পেয়েছি। বিপিসি সব সময় জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করেছে। তাহলে এখন কেন ভর্তুকি তুলে নেওয়া হলো? শুনেছি প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু টাকা খরচ করা হয়েছে। আমরা দেখছি বিপিসি নাকি সবচেয়ে ধনী গ্রাহক। বিপিসির ২৫ হাজার কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। তাহলে এসব টাকা কার? বিপিসি চাইলে এই সংকট সময়ে জ্বালানি তেলের ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে পারতো।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ভর্তুকি প্রত্যাহার সমর্থন করি কিন্তু যেভাবে করা হয়েছে, এটাকে সমর্থন করি না। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে খারাপ সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের কর তুলে দিতেই পারে। বরং দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা ভয়ংকর বৈষম্যমূলক। ধনীর কিছু হবে না, গরিব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, একবারে এত বেশি দাম বাড়ানোর মতো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখনো আসেনি। ধান চাষে প্রতি বিঘা জমিতে এক হাজার টাকা খরচ বাড়বে কৃষকের। এ খাতে ১৫ লাখ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়, যার ৭৫ শতাংশ ডিজেলচালিত। এখানে অন্তত আগের দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশ বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কারখানা পরিচালনা করতে মালিকদের এমনিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার উপর শ্রমিকের সংকট দেখা দিলে শিল্পখাতই থমকে যেতে পারে। কারণ সাংসারিক খরচ মেটাতে না পেরে অনেক শ্রমিক গ্রামে চলে যাবে।
তিনি বলেন, ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিক বিপদে পড়বে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে পোশাক শ্রমিক কাজে মন দিতে পারবে না। দাম বৃদ্ধির কারণে ডিজেল দিয়ে শিল্প চালু রাখা ফিজিবল না। এক্সপোর্ট পজিশন ভালো না। এখন ডলার ক্রাইসিস। আমরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি। কারণ বায়ারের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিতে পারছি না। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। শ্রমিক গ্রামে চলে যাবে।
তাছাড়া, ডিজেলের প্রাইস কমানো যেতো কি না বলতে পারবো না। তবে এতে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণ। তেলের দাম বৃদ্ধিতে দ্রব্যমূল্য কতটুকু বৃদ্ধি পাবে এটা সরকারকে ঠিক করতে হতো। ডিজেলের সুযোগে অনেক কিছুর দাম বাড়ছে। আমাদের পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। ডিজেলের দাম না কমালে শিল্প কারখানা বন্ধ করে বসে থাকা ছাড়া কোনো পথ নেই।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :