ঢাকা : জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বেড়েই চলেছে চালের দর। একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টন চাল কিনে মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংটক সৃষ্টি করায় চালের দর দিন দিন বাড়ছে। আর অল্প সময়েই কোটি প্রতি হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এমনটাই ভাবছেন সুশীল সমাজের অর্থনীতিবিদগণ।
তারা বলেছেন, চালের সংকট দেখিয়ে গত সপ্তাহে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ থেকে ১৫ টাকা। এর মধ্যে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। আর চিকন ও অন্যান্য চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি চিকন চাউলের মূল্য ছিল ৮০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি হয়েছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। এভাবে দিনের পর দিন চালের দর বৃদ্ধির কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে।
বর্তমানে চালের বাজারে নেই দাম কোনো কমার লক্ষণ। ফলে দিশেহারা নিম্ন আয়ের মানুষ। জ্বালানির দাম বাড়ার অজুহাতে মিল মালিক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ আড়তদার ও পাইকারদের। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন শামছুল আলম নামের এক মধ্যবিত্ত।
তিনি জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে তারা দাম বাড়িয়েছে। আবার কিছু খুচরা ব্যবসায়ী বলছেন, চালকল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চাল মজুত করছেন। এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং দাম হু হু করে বাড়ছে। এ সপ্তাহ আগে ৫০ টাকার এক কেজি চালের দর এখন ৮০ টাকা। দেশের বিভিন্ন স্থানে চালের বাজার অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। গত সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ে। উত্তরের জেলা দিনাজপুরে চালের পাইকারি মার্কেট বাহাদুর বাজারে এখনো চলছে আগের বাড়তি দামে বেচাকেনা। কমেনি দাম। চড়া দামে চাল কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান ক্রেতারা।
নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে নাভিশ্বাস মো. লিয়াকত নামের এক ক্রেতা বলেন, আগে যে চাল ৫০ টাকা দিয়ে কিনতাম, তার দাম বেড়ে এখন ৮০ টাকা। তার ওপর শাকসবজিও কিনতে হয়। এতে আমার বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। বেশি দামে ধান কেনা ও ডিজেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বাড়তি এমন অজুহাত দেখিয়ে মিল মালিক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ আড়তদার ও পাইকারদের।
তিনি আরো বলেন, আগে আমরা ৫০ কেজির চালের বস্তা কিনতাম ২ হাজার ৪০০-২ হাজার ৫০০ টাকায়। কিন্তু এখন কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ টাকায়। দাম কমার তো কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমরা মিলারদের থেকে প্রতিনিয়ত চাল কিনি। বিভিন্ন সময়ে তারা বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দেন।
এদিকে রংপুরের পাইকারি বাজারে চালের দাম গত এক সপ্তাহে ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি দেড়শ টাকা বাড়লেও চলতি সপ্তাহে ৫০ টাকা কমেছে। তবে কেজিপ্রতি এক টাকা কমার প্রভাব পড়েনি খুচরা বাজারে। তাই এর সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা।
এ বিষয়ে মো. ইকবাল নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ধানের দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে বড় বড় মিলার চালের সরবরাহ প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন। এর পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ারও প্রভাব রয়েছে। তিনি বলছেন, সব মিলিয়ে তাদের খরচ বেশি পড়ছে।
তিনি আরো বলেন, মিলাররা বলছেন যে তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। যেটি আসলেই বেড়েছে। আগে ভাড়া ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। এখন তা ১ হাজার ৬০০ টাকা। এর প্রভাব তো চালের দামে পড়বেই। মিলাররা উচ্চমূল্যে ধান কিনেছেন। তাদের যেমন ব্যয় হয়েছে, ওনারা সে অনুযায়ীই বিক্রি করছেন। আমরা তাদের কাছ থেকে যে দামে কিনে আনি, তার চেয়ে ১০-২০ টাকা লাভে বিক্রি করি।
রোববার (২১ আগস্ট) কারওয়ান বাজার সরজমিনে দেখা গেছে, প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫১ থেকে ৫২ টাকায়, বিআর আটাশ ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়, মিনিকেট ৭২ টাকা, নাজির ৮০ থেকে থেকে ৮৫ টাকায় আর চিনিগুঁড়া ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। এসব চাল গত এক সপ্তাহ আগেও ৫ থেকে ১৫ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।
হঠাৎ এই পরিমাণ দাম বৃদ্ধি কেন হলো জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ফেনী রাইস মিলের বিক্রয়কর্মী মো. মাসুম রানা বলেন, চালের বাজার এখন করপোরেট গ্রুপের হাতে। তারা হাজার হাজার টন চাল কিনে মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। আর বাজারে একটা পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে দাম এমনিতেই হু হু করে বেড়ে যাবে।
চালের পাইকারি বাজার রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের মেসার্স সূচনা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী সবুজ মিয়া বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগেও ৫০ কেজির ১ বস্তা বিআর আটাশের দাম ছিল ২৪০০ টাকা। সেই চালের বস্তা আজ ২৭৫০ টাকা। মিলাররা দাম বাড়ালে আমরা কি করব। তারা যখন যে রেট ধরে সেই রেটে মাল নিতে হয়।
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী চালের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকেদের তিনি বলেন, বর্তমানে দ্রব্যমূল্য এতটা বাড়ার কোনো কারণ নেই। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতার কারণে সবাই এক লাফে দাম বাড়িয়ে দেয়। মনে করেন, তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচের জন্য প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা করে বাড়তে পারে। সেখানে ব্যবসায়ীরা ৫ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এখানে কোনো লজিক আছে? নাই। হঠাৎ করে সুযোগ কেউ কেউ নিয়েছে। যে পরিমাণ বাড়ার কথা, তার থেকে অনেক বেশি সুযোগ নিয়েছে, এটা সত্যি কথা। আমরা চেষ্টা করছি।
শুধু রাজধানী ঢাকায় নয় এই অবস্থা সারা দেশেই। দেশের সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদনকারী জেলা দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়া জেলাতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব জেলায় হু হু করে বেড়ে গেছে চালের দাম।
আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি বস্তা ধানের দাম (৭৭ কেজি) আড়াইশ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। একই সময়ে চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দেড়শ থেকে ২০০ টাকা। চালকল মালিকরা বলছেন, ধান-চালের দাম কমতে শুরু করেছে।
দিনাজপুরের চাল ব্যবসায়ী সোলায়মান আলী সামপ্রতিক সময়ে দিনাজপুরসহ সারা দেশে ধান-চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, দেশের বড় বড় করপোরেট গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বেশি দামে ধান ক্রয় করছে। এতে কৃষকেরা ধানের দাম কিছুটা বেশি পেলেও ভোক্তারা তাদের কাছ থেকে সুন্দর প্যাকেটে ভরা চাল কিনছেন সাধারণ বাজারের তুলনায় প্রতি কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দামে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্থানীয় চালকল মালিকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ধান কিনতে পারছেন না।
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরু ও মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি তিন থেকে চার টাকা করে বাড়িয়েছে মিলগুলো। ফলে প্রতি কেজি শর্টিং করা জিরা (মিনিকেট) চাল ৭০-৭৫ টাকা ও নন-শর্টার জিরা ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কাটারি ৬৭-৬৮ টাকা, বিআর-২৮ চাল ৫২-৫৬ টাকা ও স্বর্ণা-৫ চাল ৫০-৫৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় বর্তমানে বাজারে ধানের দাম বাড়তি। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ধান-চাল পরিবহনের খরচ বেড়েছে। ফলে ধান-চাল দুটিরই দাম আরো বেড়েছে। এ নিয়ে গত দুই-তিন সপ্তাহে নওগাঁ মোকামে ধানের দাম মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এদিকে ধানের দাম ও পরিবহন খরচ বাড়ায় চালের দাম বাড়ানো হয়েছে।
রংপুর প্রতিনিধি জানান, রংপুরে কেজিপ্রতি চালের প্রকারভেদে ৬ থেকে ১০ টাকা কেজিতে দাম বেড়েছে। আড়তগুলোতে হাজার হাজার বস্তা চাল থাকলেও চালের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আকস্মিকভাবে চালের দাম বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষ, শ্রমজীবীসহ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। চালের দাম তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
এদিকে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নআয়ের মানুষ, শ্রমজীবীসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। রিকশাওয়ালা সাজাহান ও কুলি নবাব আলী সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের আয় বাড়েনি অথচ চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ৪০ টাকার মোটা চাল ৫৮ টাকায় উঠেছে। ফলে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা আধাপেট করে ভাত খেতে হচ্ছে। একই কথা জানালেন গৃহবধূ সালমা বেগম। তিনি বলেন, যেভাবে চালের দাম বাড়ছে তাতে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কিছুতেই কাটছে না কুষ্টিয়ায় চালের বাজারের অস্থিরতা। হু হু করে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। কুষ্টিয়ার বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। চালের এই দাম বৃদ্ধির লাগাম যেন কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। চালের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতা সাধারণকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে খুচরা ব্যবসায়ী ও একাধিক মিলারের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাদের দাবি, মূলত তিনটি কারণে চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমত, সরকার ডিজেলের মূল্য এক লাফে লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বৃদ্ধি করায় পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। যে কারণে ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :