• ঢাকা
  • বুধবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

ভোটের আগে সরব হচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা


নিজস্ব প্রতিবেদক  জানুয়ারি ১৫, ২০২৩, ১১:৫১ এএম
ভোটের আগে সরব হচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা

ঢাকা: সরকারি চাকরিতে উপরের দিকের পদগুলোর সুযোগ-সুবিধা ব্যাপকভাবে বাড়লেও বৈষম্যের শিকার নিচের দিকের কর্মচারীরা। ধারাবাহিক মূল্যস্ফীতির প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপদে আছেন ১০ থেকে ২০তম গ্রেডে কর্মরতরা। অষ্টম পে-স্কেল বাস্তবায়নের সাত বছরের মাথায় এসে সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আবারও সরব হচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা।

সরকারি কর্মচারীদের জন্য সর্বশেষ ২০১৫ সালে অষ্টম বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) কার্যকর করা হয়। ওই সময় ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন ১৬টি গ্রেডে বেতন নির্ধারণের সুপারিশ করেছিল। তবে সেটি বাস্তবায়ন না করে ২০টি গ্রেড বহাল রেখে বেতন কাঠামো ঘোষণা করে সরকার। এতে সর্বনিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের ৮ হাজার ২৫০ এবং সর্বোচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তাদের ৭৮ হাজার টাকা মূল বেতন নির্ধারণ করা হয়। উচ্চ পদের কর্মকর্তা ও নিম্ন পদের কর্মচারীর মধ্যে বেতনের ব্যবধান থাকাই স্বাভাবিক। তবে বিদ্যমান কাঠামোয় এই ব্যবধান আকাশ-পাতাল। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ৪ঃ১-এর মধ্যে থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি চাকরির বেতন কাঠামোতে এই অনুপাত ১ঃ৯.৫।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৫ সালে পে-স্কেল ঘোষণার পর প্রতিবছরই সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে সরকারি কর্মচারীদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। বেতনের চেয়ে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি বাড়ায় ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। চড়া দ্রব্যমূল্যের কারণে নিচের দিকের কম বেতনের কর্মচারীরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে বেতন বাড়ানোর জন্য নতুন পে-স্কেল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন কর্মচারীরা।

তারা বলছেন, উচ্চ বেতনের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধা থাকায় উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের জীবনযাপনে তেমন কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু কম বেতনের কর্মচারীরা আর চলতে পারছেন না। ৯ বছরে সব ক্ষেত্রে ব্যয় ব্যাপকহারে বাড়লেও বেতন বেড়েছে সেই তুলনায় একেবারেই সামান্য। ফলে এই বাজারে কোনো কর্মচারীর পক্ষেই সততার সঙ্গে ভালোভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়।

আক্ষেপ করে এক সরকারি কর্মচারী বলেন, ‘সরকারি দপ্তরগুলোর উপরের দিকের কর্মকর্তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে জিনিসপত্রের দাম অনেক বাড়লেও তাদের সমস্যা নেই। উপরওয়ালাদের পেট সব সময়ই ভরা থাকে। কিন্তু নিচের দিকে যারা আছেন, তাদের এখন হাহাকার চলছে।’

জানা গেছে, বেতন বৈষম্য নিরসনে সরকার ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল। তবে পৌনে চার বছর পার হলেও দৃশ্যমান কাজ করেনি সেই কমিটি। তবে সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বছরে এসে নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করা হবে—এমনটাই আশা ছিল সরকারি কর্মচারীদের, কিন্তু এরই মধ্যে সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত ১০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে তিনি জানান, ‘করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে বিশ্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে সরকার ‘ফ্যামিলি কার্ডের’ মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য প্রদানের কার্যক্রম চালু করেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতা প্রদানের কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই।’

অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় সরকারের পক্ষে মহার্ঘ ভাতা বা নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন করা কঠিন বলে মনে করেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান। তিনি বলেন, ‘কম বেতনের কর্মচারীরা কষ্টে আছেন, এ কথা সত্য। কিন্তু বর্তমানে অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে নতুন পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সুযোগ নেই। কম বেতনের কর্মচারীদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সরকার তাদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে পারে।’

এদিকে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সরব হয়ে উঠছে সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন। অষ্টম পে-স্কেলকে বৈষম্যমূলক দাবি করে নবম পে-স্কেল ঘোষণা করাসহ বেশ কিছু দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন সংগঠনের নেতারা। তাদের ভাষ্য, বর্তমান পে-স্কেলে বেতন বৈষম্য আকাশচুম্বী। বিশেষ করে ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে সংসার চালাতে পারছেন না। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এই বৈষম্য দেখার কেউ নেই। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সচিবালয়ে কর্মরত ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা (এও) দশম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে উন্নীত হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। আবার সচিবালয়ের বাইরে বিভিন্ন অধিদপ্তর-দপ্তরে কর্মরত কর্মচারীদের বড় একটি অংশ তাদের পদের নাম পরিবর্তন করে সচিবালয়ের মতো প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) করার দাবি জানাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু সচিবালয়েই সরকারি কর্মচারীদের এক ডজনেরও বেশি সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংগঠনগুলো হলো—বাংলাদেশ সচিবালয় পার্সোনাল অফিসার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সচিবালয় অ্যাডমিনিস্ট্রিভ অফিসার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সচিবালয় ১৬-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারী সমিতি, বাংলাদেশ সচিবালয় কম্পিউটার অপারেটর ও সাঁট মুদ্রাক্ষরিক সমিতি, বাংলাদেশ সচিবালয় স্টেনো টাইপিস্ট সমিতি, কেয়ার টেকার প্রতিষ্ঠান সমিতি, ইডেন গণপূর্ত সমিতি, বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ এবং বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। এসব সংগঠনের বাইরে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়-বিভাগভিত্তিক আরও সংগঠন আছে। তবে সচিবালয়ে সবচেয়ে সক্রিয় ও বড় সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। সচিবালয়ের বাইরেও সরকারি কর্মচারীরা বিভিন্ন ব্যানারে দাবি আদায়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। এসব সংগঠনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি বাস্তবায়ন ঐক্য ফোরাম, বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতি, বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশন উল্লেখযোগ্য। তবে সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরের সব সংগঠনের কিছু কিছু দাবি অভিন্ন। বিশেষ করে নবম পে-স্কেল ঘোষণা, মহার্ঘ ভাতা, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড এবং বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির বিষয়গুলোতে সব সংগঠনের অবস্থান এক ও অভিন্ন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক সংগঠনের সঙ্গে আরেক সংগঠনের তীব্র মতবিরোধ রয়েছে।

ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের (এও) পদ নবম গ্রেডে উন্নীত করাসহ ৯ দফা দাবি আদায়ে সোচ্চার রয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। সংগঠনটির অন্যান্য দাবি হচ্ছে—উপসচিব পদের মতো ৫০০ সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে এও-পিওদের সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করা, ৫০ শতাংশ হারে সচিবালয় ভাতা প্রদান, সহকারী সচিবের প্রাপ্য ১৮৪টি পদ সংরক্ষণ করা এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ করা।

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ নামে একটি সংগঠন ২৫ দফা দাবি জানিয়েছে। কর্মচারী সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব রেখে স্থায়ী পে-কমিশন গঠন, নতুন পে-কমিশন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা, বেতন স্কেল ২০ ধাপ ভেঙে ১২ ধাপ করা, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা, টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করাসহ এসব দাবি আদায়ে শিগগিরই কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।

দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সচিবালয়ের বাইরের অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও দপ্তরের প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও সহকারীরা পদবি পরিবর্তন চেয়ে সচিবালয়ের মতোই দশম গ্রেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন।

বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদের মহাসচিব আবু নাসির খান বলেন, ‘সরকার সচিবালয়ের ভেতরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদটি বাস্তবায়ন করলেও শিক্ষাগত যোগ্যতা একই থাকার পরও সচিবালয়ের বাইরে কর্মরতদের পদ পরিবর্তন করছে না। ২০১৮ সালের ৭ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আমাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে নির্দেশনা দেন। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩২তম বৈঠকে উচ্চমান সহকারী ও প্রধান সহকারী পদগুলোকে সচিবালয়ের মতো পদবি পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে সচিবালয়ের মতো অন্যান্য দপ্তরের পদবি পরিবর্তন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করাসহ বেতন দশম গ্রেডে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়। এরপরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আমাদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়ন করছে না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’

এ ছাড়া কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের ৬ দফা, চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতি ১০ দফা এবং সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদের ৭ দফা দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সব সংগঠনের অন্যতম দাবি মহার্ঘ ভাতা ও নতুন পে-স্কেল ঘোষণা। সূত্র: কালবেলা

সোনালীনিউজ/এম

Wordbridge School
Link copied!