ঢাকা : উদ্বেগ ও শঙ্কার মধ্যে বিদ্যুৎবিহীন কক্সবাজারে তাণ্ডব চালিয়ে উপকূল পেরিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’; যাওয়ার আগে প্রাণহানির যেমন ঘটিয়েছে, তেমনি লণ্ডভণ্ডের মুখে পড়েছে শহর ও গ্রামের অনেক এলাকা। বসতবাড়ি ধসে পড়ার খবরের পাশাপাশি বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে শত কিলোমিটার গতিবেগের আশেপাশে আঘাত হানা এ ঝড়।
সাগরে জলোচ্ছ্বাস আর প্রবল ঝড়ো বাতাসের মধ্যে সন্ধ্যার কিছু পরেই আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে শুরু হওয়া ঘূর্ণিঝড় হামুন।
মঙ্গলবারের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে তা পরদিন আঘাত হানার শঙ্কার কথা উঠে এলেও তা গতিপথ বদলে এদিন সন্ধ্যার পরেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে। পরে রাত ১টার দিকে এটি শান্ত হয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়।
আগের চেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে ঘূর্ণিঝড় উপকূলের কাছাকাছি এলে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে। সাগরে জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়। জেলার উপকূলজুড়ে প্রায় পৌনে তিন লাখ বাসিন্দাকে তীরবর্তী এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। ঝড়ের গতিবেগ বাড়তে থাকলে অনেকস্থানে গাছপালা ভেঙে পড়ে। এমন খবরে আগাম সতর্কতা হিসেবে বিদ্যুৎ বন্ধ শহর ও উপজেলায়।
ঘূর্ণিঝড় হামুন উপকূল অতিক্রম করার শুরুর দিকেই ঝড়ে বিপুল সংখ্যক গাছপালা এবং কাঁচা ও আধাকাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। ৮০ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানলেও এক পর্যায়ে ঝড়ের গতিবেগ শত কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। কক্সবাজারে রাত ৮টায় ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ১০৪ কিলোমিটার পর্যন্ত রেকর্ড হয় বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘর ধসে পড়ার খবরের পাশাপাশি ছোট-বড় সাইনবোর্ড ভেঙে পড়ে থাকতে দেখার খবর দিয়েছেন স্থানীয়রা। জেলার বেশিরভাগ এলাকায় সন্ধ্যা থেকেই বিদ্যুৎ নেই।
ঘূর্ণিঝড় কুতুবদিয়ার পাশ দিয়ে অতিক্রমের সময় পাশের উপজেলা মহেশখালীতেও প্রভাব ছিল বেশ। প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনেও ঝড়ের প্রভাব ছিল। তবে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ মেলেনি।
ঝড়ের তাণ্ডবে কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলীতে মাটির দেওয়াল চাপায় একজন এবং মহেশখালী উপজেলায় গাছচাপায় একজনের মৃত্যুর খবর এসেছে। এছাড়া দেয়াল চাপা ও গাছপালা পড়ে বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর থেকে ঘূর্ণিঝড় হামুন কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানা শুরু করে। এরপর একটানা রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূল ও এর আশপাশের অঞ্চল দিয়ে ব্যাপক ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। একই সঙ্গে শুরু হয় বজ্র বৃষ্টি।
শহরের প্রধান সড়কে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরসহ অনেক এলাকায় ঝড়ের আঘাতে গাছ উপড়ে পড়ে। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। বিদ্যুতের খুঁটি ও সঞ্চালন লাইনের ক্ষতি হয়েছে বলেও তথ্য এসেছে।
শহরে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি বলেন, আমার বয়সে এমন ঝড় দেখি নাই। কীভাবে ঘর থেকে বের হইছি তা বলে বোঝাতে পারব না।
ঘূর্ণিঝড় এত বেশি জোরে আঘাত হানবে তা চিন্তাতেও ছিল না বলে মন্তব্য করেন পৌর শহরের আতঙ্কিত এক নারী।
সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখা গেছে। তবে গতিবেগ খুব বেশি না হওয়ায় খুব বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনার খবর আসেনি।
রাতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান দুইজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন। কক্সবাজার শহরের সমিতি পাড়া কুতুবদিয়া পাড়াসহ জেলার উপকুল এলাকায় ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
বুধবার (২৫ অক্টোবর) ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনদের শুকনো খাবার ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় দিনভর জেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়ার তথ্যও তুলে ধরেন তিনি।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ঝড়ে পৌরসভার সমিতি পাড়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুরো শহরে অনেক গাছপালা ভেঙে গেছে। প্রায় শতাধিক কাঁচা-পাকা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। একজন দেয়াল চাপায় মারা গেছেন।
তিনি জানান, ঝড় কিছুটা কমে এলে রাতে অনেককে উদ্ধার করা হয়। পাশের পাহাড় থেকে অনেক বাসিন্দাকে নামিয়ে আনা হয়েছে। প্রতিটা ওয়ার্ড ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন কাউন্সিলররা। এছাড়া সড়কের ওপর ভেঙে পড়া গাছ অপসারণে কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে পৌরসভার পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে বলেও জানান পৌর মেয়র।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সৈকতে বিপদ সংকেতের অংশ হিসেবে পর্যটকদের সতর্কতা হিসেবে মাইকিং করা হয়েছে। এ ছাড়া সৈকতে দায়িত্বরত লাইফ গার্ড কর্মীরা পর্যটকদের নিরাপদে থাকতে মাইকিং করছে।
তিনি জানান, কক্সবাজারের উপকুলীয় এলাকার মানুষদের সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। উপকূলের নৌযান এবং মাছ ধরার নৌকাগুলোকে উপকূলের নিরাপদ স্থানে থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সাগরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।
এর আগে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন দুপুরে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্হাপনা কমিটির সভা করে। উপকূল এলাকায় লোকজনদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে মাইকিং করে। রাত পর্যন্ত পৌনে তিন লাখ মানুষক আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানিয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ এর গতিপথ ঘুরে যাওয়ায় কয়েক জেলার মানুষকে আর আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়নি।
মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) রাত ১২টা পর্যন্ত ১১ জেলার দুই লাখ ৭৩ হাজার ১৫২ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, অনেক জেলায় মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও সেখান থেকে চলে গেছেন।
সন্ধ্যায় থেকেই বিদ্যুৎবিহীন কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দমকা হাওয়া শুরু হলে ও উপকূল উত্তাল হয়ে পড়লে সতর্কতার অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে কক্সবাজারে। সন্ধ্যার থেকে অন্ধকার হয়ে পড়েছে পর্যটননগরী। রাত ১১টার পর পুরো জেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছে কর্মকর্তারা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে কক্সবাজার শহরের পাশাপাশি জেলার অনেক অংশে বিদ্যুৎ বন্ধ থাকার কথা জানিয়েছেন, জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী গোলাম আহম্মদ।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কক্সবাজারের সহকারী প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবির রাত ৮টায় জানান, এখন প্রবল ঝড় বইছে। এই এলাকার সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তা গোলাম আহম্মদ বলেন, ঝড়ের গতি বেশ। বিভিন্ন জায়গায় গাছ পড়ছে। এসব কারণে সাড়ে ৭টা থেকে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এর আগে সন্ধ্যা ৭টার দিকে পিডিবির লাইনের বিদ্যুৎও বন্ধ রাখা হয় বলে জানান তিনি। এখন কক্সবাজার পরোপুরি অন্ধকারে, বলেন তিনি।
রাত ১টায় উপকূল অতিক্রম, নামল সংকেত : মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যার পর থেকে প্রবল ঝড়ো বাতাস, কয়েক ফুট উচুঁ জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে কক্সবাজারে আঘাত হানে কিছুটা দুর্বল হয়ে ওঠা হামুন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা তাণ্ডবের পর ক্ষয়ক্ষতির রেশ রেখে রাত ১টার দিকে এটি উপকূল অতিক্রম করে।
রাত সোয়া ১টায় আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, হামুন দুর্বল হয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় স্থল গভীর নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করছে। এটি স্থলভাগের আরও অভ্যন্তরে অগ্রসর হয়ে ও বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হবে।
উপকূলে আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে পড়ায় দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে সতর্ক সংকেত নামিয়ে ফেলতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) রাত সোয়া ১টায় আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিকের স্বাক্ষরে ঘূর্ণিঝড় হামুনের সর্বশেষ বুলেটিনে বলা হয়, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় হামুন রাত ১টায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করেছে।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হামুন স্থলভাগের ভেতরে আরো অগ্রসর হবে এবং বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকবে।
ঝড়ের বিপদ কমে আসায় সংকেত কমিয়ে এনেছে আবহাওয়া অফিস। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আর মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৫ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
তবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এমটিআই