ঢাকা : ভোরে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিমানবন্দর স্টেশনে বিরতির পর যখন কমলাপুরের দিকে ছেড়ে যায়, তখনই এটির একটি বগিতে আগুন দেখতে পান যাত্রীরা। এরপরও সেই ট্রেন কেন আরও ১৫ মিনিট দূরের পথ তেজগাঁও স্টেশন পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া হলো সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা।
মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোরে নাশকতার সেই আগুনে মা-শিশু সন্তানসহ চারজনের প্রাণহানির পর আহত ব্যক্তি, ট্রেনটির যাত্রীসহ অনেকের মধ্যেই এ প্রশ্ন ঘুরছে।
ভোর ৫টার দিকে জ্বলন্ত ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনও অতিক্রম করে চলে যাচ্ছিল, এমনটাই দাবি এ স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার পর্বত আলীর। নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটিতে আগুন দেখে সংকেত দিলে স্টেশন থেকে পাঁচশ গজ দূরে ট্রেন থামান চালক। ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। নাশকতার আগুনে পুড়ে বগির মধ্যেই প্রাণ গেছে চারজনের; অসুস্থ ও আহত হয়েছেন অন্যরা।
নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভোরে ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন থামে। সেখান থেকে ছাড়ার পরপরই এটিতে আগুন দেখতে পাওয়ার তথ্য দিয়েছেন অনেকে। তবে সে খবর ট্রেনটির পরিচালক বা চালকের কাছে পৌঁছে দেননি আগুন লাগা বগির অ্যাটেনডেন্ট মাইনুদ্দীন মানিক। আগুন ছড়াতে শুরু করার পরও ট্রেনটি থামানো যায়নি বলে ভাষ্য রেল সংশ্লিষ্টদের।
ঘটনার পর থেকে মানিকের সঙ্গে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করতে পারেননি, যে কারণে তার বক্তব্যও মেলেনি। তবে তিনি পুলিশের কাছে ঘটনার একটা বর্ণনা দিয়েছেন, যাতে আগুন লাগার পরপরই তা নেভানোর দাবি করেছেন।
রেলওয়ে ও রেল পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রেনটি চলন্ত থাকায় একদিকে বাতাসে আগুন যেমন বেড়েছে, আরেকদিকে ট্রেন থেকে সহজে নামতে পারেননি আতঙ্কিত যাত্রীরা। তেজগাঁও স্টেশনের অদূরে ট্রেনটি থামার পর সেটির আগুন নেভায় ফায়ার সার্ভিস। পরে একটি কামরা থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে রেল পুলিশের ঢাকা জেলার সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পরপরই ‘জ’ ও ‘ঝ’ বগির মাঝের সংযোগস্থলে আগুন দেখতে পান যাত্রীরা। এরপর জ বগির অ্যাটেনডেন্ট মাইনুদ্দীন মানিক দুই ট্রেনের মাঝে থাকা একটি এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।
মাইনুদ্দীন পুলিশকে বলেছেন, প্রাথমিকভাবে তিনি আগুন নেভাতে সফল হয়েছেন বলে মনে করছিলেন। তিন থেকে চার মিনিট পরে আবারও আগুন জ্বলে ওঠে। এবার আগের চেয়ে বেশি মাত্রায়, দাউদাউ করে। এই আগুন আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দুই বগির মাঝের সংযোগ রাবারেও আগুন লেগে যায়।
তবে আগুন লাগার পরপর ট্রেনটি কেন মাঝের ক্যান্টনমেন্ট বা বনানী স্টেশনে থামানোর চেষ্টা হয়নি সে বিষয়ে পুলিশের কাছে এখনও কোনো উত্তর নেই জানিয়ে তিনি বলেন, একটি ট্রেন হুট করে থামানো যায় না এটা সত্য। তবে এ বিষয়ে রেলের কর্মকর্তারা বিস্তারিত বলতে পারবেন।
‘আগুন দেখে ট্রেন থামানোর সিদ্ধান্ত নিই, নইলে বিপদ বাড়ত’
ট্রেনে থাকা যাত্রী নুরুল হক ওরফে আব্দুল কাদের (৫৩) আহত অবস্থায় ভর্তি রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে। তড়িঘড়ি করে নামতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তিনিও আগুন নেভানোর জন্য রেল কর্মীদের ফায়ার এক্সটিংগুইশার হাতে ছোটাছুটি করতে দেখেছেন।
তবে রেলের কর্মীরা কেন ট্রেনটির পরিচালক (গার্ড) বা চালককে (লোকো মাস্টার) বিষয়টি জানাননি তা স্পষ্ট নয়।
রেলের কর্মকর্তারা ও ট্রেনটিতে কর্মরত ব্যক্তিরাও কেউ স্পষ্ট করে বিষয়টি বলতে পারছেন না কেন এই আগুন লাগা ট্রেনটিকে সঙ্গে সঙ্গে থামানো গেল না।
ট্রেনের প্রতি বগির জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাটেনডেন্ট (পরিচর্যক) থাকেন। পুরো ট্রেনের দায়িত্বে থাকেন একজন গার্ড (পরিচালক)। ট্রেনের ইঞ্জিন পরিচালনা করেন একজন লোকো মাস্টার (এলএম) ও তার একজন সহকারী।
জরুরি পরিস্থিতিতে ট্রেন থামানোর জন্য প্রতি ট্রেনেই একটি ব্যবস্থা রয়েছে অ্যাটেনডেন্টদের কাছে। তারা সেটির ব্যবহার কেন করলেন না সেটিও স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ।
রেলের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রথম কাজ হচ্ছে ট্রেনটি থামানো। সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষরট কর্তৃপক্ষ ও কন্ট্রোল রুমকে অবহিত করা।
ট্রেনটির পরিচালকের দায়িত্বে থাকা খালেদ মোশাররফ বলছেন, অ্যাটেনডেন্টরা তাকে কিছুই জানাননি। ১৪ রেকের ট্রেনটিতে তার অবস্থান ছিল একেবারে শেষের বগিতে। আগুন লেগেছিল ট্রেনের মাঝামাঝি ৬, ৭ ও ৮ (ছ, জ ও ঝ) নম্বর বগিতে।
ট্রেনটি মহাখালী ছাড়ার পর তেজগাঁওয়ের সিগন্যাল গ্রিন কি না তা দেখতে গিয়ে সামনের বগিতে ধোঁয়া দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের চালককে (লোকো মাস্টার) মোবাইলে ফোন করে বিষয়টি জানালে চালক ট্রেন থামিয়ে দেন।
চালক (এলএম) দিলীপ কুমার মণ্ডলও কোনো সংকেত পাননি জানিয়ে বলছেন, বগিতে আগুন লাগলে সেই তথ্য তাকে না জানালে ইঞ্জিনের ভেতরে বসে তা বোঝা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তেজগাঁও রেলস্টেশনে তাকে আগুনের কথা জানানো হলে তিনি ট্রেন থামান।
তবে ট্রেনে ছ, জ বা ঝ বগির দায়িত্বে থাকা অ্যাটেনডেন্টরা তখন কেন ট্রেন থামানোর উদ্যোগ নেননি সে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি কোনো কর্মকর্তা।
সেই ট্রেনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাটেনডেন্ট ও সংশ্লিষ্টরা তাদের কী জানিয়েছেন-এমন প্রশ্নে রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন্স) এ এম সালাহ উদ্দিন বলেন, ট্রেনটা তাৎক্ষণিকভাবে থামানো হয়নি, এই বিষয়টা আলোচিত হচ্ছে। আগুনের বিষয়টা ট্রেনের গার্ড (পরিচালক) বা লোকো মোস্টারকে (চালক) দিতে পেরেছিল কী না তা জেনে আমি বলতে পারবো আসলে কোথায় গ্যাপটা হয়েছে।
বিষয়টা আসলে তদন্তাধীন আছে। যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি আগুনটা কেউ বাইরে থেকে ছুড়ে দেয়নি। কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ট্রেনের বগিতে আগুনটা লাগিয়ে দিয়েছে।
আগুনটা কীভাবে ছড়ালো বা কেন ট্রেনটিকে সাথে সাথে থামানো গেল না এই বিষয়ে টু দ্য পয়েন্ট তথ্য না পেয়ে আসলে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এ ঘটনা তদন্তে দুটো কমিটি গঠনের কথাও জানান রেলের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।
ভোরে তেজগাঁও স্টেশনে কর্মরত পর্বত আলী বলেন, ঢাকায় ঢোকার পর বিমানবন্দর স্টেশনে থেমে সর্বশেষ যাত্রী উঠানামা করে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে অতিক্রম করে ট্রেনটি। এই স্টেশন অতিক্রম করার সিগন্যাল পাওয়ার পর পরবর্তী তেজগাঁও স্টেশন অতিক্রম করার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দিয়ে রাখেন তিনি। কারণ এই স্টেশনে ট্রেনটির দাঁড়ানোর কথা ছিল না।
ট্রেনটি স্টেশন অতিক্রমের সময় বাইরের প্ল্যাটফরমে সবুজ পতাকা নিয়ে দাঁড়ান তিনি। তখন ৪টা ৫৮ মিনিট। ট্রেনটি স্টেশনে ঢোকার সময় একটি বগি থেকে আগুনের সাথে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখে দ্রুত কন্টোল রুমে গিয়ে গ্রিন সিগন্যাল বাতিল করে সিগন্যাল রেড করে দেন তিনি। ফলে ট্রেনটি মূল স্টেশন থেকে প্রায় পাঁচশত গজ দূরে গিয়ে থেমে যায়। পরে গিয়ে দেখা যায় ট্রেনের ছ, জ, ঝ নামের বগিগুলো পুড়ে গেছে।
পর্বত আলীর ধারণা, বিমানবন্দর স্টেশনে নাশকতাকারীরা আগুন লাগিয়ে অন্য বগিতে চলে যেতে পারে। পরে তারা হয়তো নেমে গেছে।
রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক এ এম সালাহ উদ্দীন বলেন, ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকার তৈরি এই কোচগুলো ২০১৯ সালে রেলে যুক্ত হয়। কোচগুলো পুড়ে যাওয়ায় প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
এমটিআই