ঢাকা: বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনের ঘটনায় দুই যাত্রীকে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ, যারা কুষ্টিয়া থেকে উঠেছিলেন; আর রাজধানীর একটি বস্তি থেকে পেট্রোল বোমাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
বিরতিহীন এ ট্রেন সবশেষ থেমেছিল ফরিদপুরের ভাঙা স্টেশনে। সেখান থেকে ছেড়ে আসার পর শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ঢাকায় ঢোকার মুখে আগুনে এটির তিনটি বগি পুড়ে যায়, যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় চার লাশ।
পুলিশ বলছে, যে দুই যাত্রীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে তারা কুষ্টিয়া থেকে উঠেছেন। তাদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। ট্রেনে আগুনের পর মধ্যরাতে ঢাকার জুরাইন রেললাইন সংলগ্ন বস্তি থেকে তিনজনকে আটকের কথা জানিয়েছে র্যাব। আর রেল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
আলমগীর, রাব্বী ও কাশেম নামে তিনজনকে রেললাইনের পাশেই একটি ঘর থেকে পেট্রোল বোমা বানানোর সময় আটক করার কথা তথ্য দেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
রাত দেড়টার দিকে ঘটনাস্থলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “ট্রেনে আগুন লাগার পর আমাদের গোয়েন্দারা তথ্য পায় জুরাইন বস্তিতে কিছু সন্দেহজনক ব্যক্তি আনাগোনা করছেন। এরপর র্যাব-৩ অভিযান চালিয়ে আলমগীর, রাব্বী ও কাশেম নামের তিনজনকে আটক করে।"তারা এখানে বসে বিপুল পরিমাণে ককটেল ও পেট্রোল বোমা বানাচ্ছিল। ৩০টি তৈরি ককটেল ও ২৮টি পেট্রোল বোমা পাওয়া গেছে।"
ট্রেনের আগুনের সঙ্গে তাদের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না জানতে চাইলে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, “এটা স্পষ্টই নাশকতা। যাত্রীরা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন তারা কয়েকজনকে দেখেছেনও।
"আর জুরাইনে যেখান থেকে এই তিনজনকে ধরা হলো যেখান থেকে ট্রেনে খুব সহজে অগ্নিসংযোগ করা সম্ভব। কোনো সম্ভাবনাই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। তাদেরকে ব্যপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।"
এ অভিযান রাত ১২টার পর হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, "আমরা সময় পেয়েছি কম, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা শুধু আয়নালের কথাই বলেছেন। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।“তিনি আরও বলেন, “যেখানে আমরা মনে করি জায়গাটা একদম রেললাইনের পাশে। এখানে বসে ট্রেন বা যে কোনো জায়গায় নাশকতা করা সম্ভব।”
এর আগে ট্রেনে আগুনে চারজনের প্রাণহানির পর জুরাইন রেলগেইট সংলগ্ন বস্তির একটি বাড়ি ঘিরে রাখার বার্তা দিয়েছিল পুলিশের বিশেষ এ ইউনিট। তখন সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ ককটেল, পেট্রোল বোমা ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছিল।
র্যাবের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিটও সেখানে পৌঁছে কাজ করছে বলে, সংবাদ মাধ্যমকে জানানো হয়। পরে অভিযান শেষে মধ্যরাতে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “আটক ব্যক্তিদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। তাদের মাদকাসক্তও মনে হয়েছে।
তাদের কাছ থেকে আয়নাল নামের এক ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে, যিনি তাদের দিয়ে ককটেল ও পেট্রোল বোমা বানাচ্ছিলেন। এর আগেও আয়নাল তাদের কাছ থেকে বোমা বানিয়ে নিয়েছেন। সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় তারা এর আগে সরবরাহ করেছে।
তবে আয়নালের কোনো পরিচয় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জানাতে পারেননি জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, ওই ব্যক্তি ফতুল্লায় থাকেন। বিভিন্ন সময় নাশকতার জন্য আয়নালের কাছ থেকে টাকা পেয়ে তারা বোমা বানিয়েছে।
পুড়ে যাওয়া বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের ঘটনাস্থলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারি বিভাগের উপকমিশনার ইকবাল হোসাইন বলেন, “ট্রেনের দুইজন যাত্রীকে স্পটেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের আমরা আটক করিনি, বলতে পারেন নজরদারিতে রেখেছি।”
তিনি বলেন, “ফরিদপুরের ভাঙ্গার পরে ট্রেনটি আর থামেনি। ঢাকা থেকে উঠে কেউ এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ এটির সর্বশেষ স্টপেজ ছিল ভাঙ্গা স্টেশন।”
যে দুই যাত্রীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে তারা কুষ্টিয়া থেকে উঠেছেন। তাদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। শুক্রবার রাতে পদ্মা সেতু হয়ে যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে আগুন লাগলে সেটি শেষ গন্তব্যস্থল কমলাপুর পৌঁছার কিলোমিটার দুয়েক আগে থেমে যেতে বাধ্য হয়। ট্রেনটির তিনটি বগি পুড়ে যায়; উদ্ধার করা হয় চার লাশ।
এর মধ্যে তিনজনই একই পরিবারের, যারা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ভোটের এ সময়ে বিএনপির ডাকা হরতালের আগের এ রাতে ৯টার দিকে গোপীবাগ আবাসিক এলাকার মধ্যে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে জ্বলতে দেখেন। পরে সেটি অদূরেই থেমে যায়।
ঘটনাস্থলে আসা রেলওয়ের ডিআরএম সফিকুর রহমান জানান, ট্রেনটিতে রেল পুলিশের সাতজনের একটি দল ছিল। রাত ৯টা ৪ মিনিটে কন্ট্রোল রুমে ট্রেনে আগুনের খবর দেওয়া হয়। তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে ট্রেনটিকে দাঁড় করানো হয়।
তিনি জানান, গেণ্ডারিয়া স্টেশন পার হওয়ার কিছুক্ষণ পর ওই আগুনটি দেখা যায়। এখানে ট্রেন থামে না, কিন্তু এই এলাকায় ট্রেন একটু স্লো হয়। চলন্ত ট্রেনের দরজাও বন্ধ থাকার কথা ছিল। তবে ঘটনার সময় কী হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না।
ঘটনাস্থলে রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি দিদার আহমদ বলেন, ট্রেনটিতে পাঁচজন পুলিশ ও দুইজন আনসার সদস্যের একটি দল নিরাপত্তার জন্য ছিল। আগুন লাগার পরপর পুলিশ সদস্যরাই চেইন টেনে ট্রেনটি থামান। তাতে যাত্রীরা নামতে পারেন। তবে আগুনে ট্রেনের পাওয়ার কার, এর পরের ‘চ’ বগি ও ‘ছ’ বগি পুড়ে যায়।
রাতে পোড়া ট্রেনটির নিচে রেললাইনের কালো পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জানালার কাঁচের টুকরো, নারী-শিশুদের স্যান্ডেল, পোড়া কাপড়-ব্যাগসহ নানা কিছু জানান দিচ্ছিল শেষ সময়ে আতঙ্কিত যাত্রীদের বাঁচার যুদ্ধের কথা।
ট্রেনের দগ্ধ তিন যাত্রীকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলেন, চিকিৎসক কৌশিক বিশ্বাস, ব্যাংক কর্মকর্তা আসিফ মোহাম্মদ খান ও নাফিস আলম।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর দিলেও নিখোঁজের তথ্য মধ্যরাতেও বলতে পারেনি। পুলিশের ওয়ারি বিভাগের উপ কমিশনার ইকবাল হোসেন বলছেন, চারজন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তবে কতজন নিখোঁজ রয়েছেন তা বলা যাচ্ছে না।
রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মো. দিদার আহম্মদ মধ্যরাতে জানান, রেল কর্তৃপক্ষ এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটিতে রেল পুলিশের একজন সদস্য রাখার কথা বলা হলে আমরা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার নাম রেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের করা কমিটিতে অন্য দু'জন কারা এবং কতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে সেই তথ্য পাওয়া যায়নি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টদের অনেককে রাতে পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তা দিদার জানান, রেল পুলিশ পৃথক কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করবে না।
এ ঘটনায় কমলাপুর রেলওয়ে থানায় নাশকতা এবং হত্যার অভিযোগে যে মামলা হবে সেটির তদন্ত করবে রেল পুলিশ বলে জানান তিনি।
এআর