ঢাকা: প্রচার শেষে ভোটের সরঞ্জাম কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছেছে আগেই, কঠোর নিরাপত্তায় ব্যালট পেপার পৌঁছে যাবে সকালের মধ্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৈরি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ।
রোববার সকাল ৮টায় দেশের ২৯৯ আসনের ৪২ হাজার কেন্দ্রে শুরু হবে ভোটগ্রহণ, একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে।
প্রায় ১২ কোটি ভোটার ব্যালট পেপারে সিল মেরে প্রায় দুই হাজার প্রার্থীর মধ্যে থেকে বেছে নেবেন তাদের প্রতিনিধি, আগামী পাঁচ বছর তাদেরকেই জাতীয় সংসদে দেখা যাবে আইনপ্রণেতার ভূমিকায়।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের মত সব দলকে সঙ্গী হিসেবে পায়নি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। বড় দল বিএনপির বর্জন এবং ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের আসন ভাগাভাগির সমঝোতায় নতুন সংসদে দুদিকের আসনে কারা বসতে যাচ্ছেন, তা সহজেই অনুমেয়। এ অবস্থায় ভোটারদের কেন্দ্রে এনে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন করাই এখন নির্বাচন কমিশনের মূল চ্যালেঞ্জ।
আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন শুক্রবারই বলেছিলেন, ভোট ঘিরে নাশকতা করে আতঙ্ক সৃষ্টির পরিকল্পনা খবর পুলিশের হাতে এসেছে। তারপরও নাশকতা ঠেকানো যায়নি। ভোট ঠেকাতে বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার হরতাল শুরু হয়েছে শনিবার সকাল থেকে। দুই দিনে প্রায় দুই ডজন ভোটকেন্দ্র পুড়েছে নাশকতার আগুনে।
হরতালের আগের রাতে ঢাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেসে দেওয়া আগুনে পুড়ে প্রাণ গেছে চারজনের, সে ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশের মানুষকে। ভোট ঘিরে নাশকতার এসব ঘটনায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এসেছে নির্বাচনের আগের দিনও।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন শনিবার চট্টগ্রাম নগরীতে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে তল্লাশি চালায় ডক স্কোয়াড। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির ‘অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাসীকাণ্ড’ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছে। সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক পাহারায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
দলটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বলেছেন, “দেশের জনগণের সাংবিধানিক চর্চায় বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই।… দেশবাসীকে বলব সব ষড়যন্ত্র-ভয় উপেক্ষা করে আগামীকাল গণতন্ত্রের উৎসবে অংশ নিন।”
অন্যদিকে ট্রেনে নাশকতাসহ অগ্নি সন্ত্রাসের ঘটনায় ক্ষমতাসীনদেরই দুষছে নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি। শনিবার হরতালের সকালে ঢাকায় ঝটিকা মিছিল করে তিনি বলেছেন, “এটি আসলে ভাগবাটোয়ারার ডামি নির্বাচন। ভোটারদের প্রতি আমাদের আহ্বান, কেউ ভোট কেন্দ্রে যাবে না, এই ভোটকে না বলুন। সকলে নিজের নিজের বাড়িতে থাকুন।”
তারপরও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, “গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরোধ, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এমন কোনো উদ্ভট ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেন না এবং ইন্ধন যোগাবেন না।”
কেবল ভোট বিরোধীদের নাশকতা নয়, শান্তিভঙ্গ হতে পারে এমন আরো কারণ ভোটের মাঠে আছে। বিএনপিহীন নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর কৌশলে আসনে আসনে ক্ষমতাসীনদের নৌকার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা। ভোটের মাঠে তাদের মরিয়া লড়াই যে সহিংসতার কারণ হতে পারে, সেই নমুনা প্রচারপর্বেই দেখা গেছে।
তারপরও ভোটারদের সাহস নিয়ে কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ভোটের আগের সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, “নাশকতা ও সহিংসতার কতিপয় সাম্প্রতিক ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। তারপরও অলঙ্ঘনীয় সাংবিধানিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে জনগণকে অনুরোধ করছি আপনারা সকল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে নির্ভয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে এসে অবাধে মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করে মূল্যবান নাগরিক দায়িত্ব পালন করবেন।”
শনিবার কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয় ভোটের সরঞ্জাম, ব্যালট পেপার যাবে রোববার সকালে। জাতীয় সংসদে আসন সংখ্যা ৩০০ হলেও রোববার ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল হকের মৃত্যুতে নওগাঁ-২ আসনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম বাতিল করেছেন নির্বাচন কমিশন। সেই ভোটের সময় পরে জানানো হবে।
ভোটার: ২৯৯ আসনে ভোটার ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৪ জন। তাদের ৬,০৫,৯২,১৯৭ জন পুরুষ; ৫,৮৭,৩৯,৮৮৯ জন নারী এবং ৮৪৮ জন হিজড়া। ভোটের সময়: ভোট চলবে রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।
কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ: ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্রের ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৬টি ভোটকক্ষে নেওয়া হবে ভোট। কীভাবে ভোট: ২৯৯টি আসনের সবগুলোতেই ভোট হবে ব্যালট পেপারে।
ফল ঘোষণা: কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণনা শেষে প্রিজাইডিং অফিসাররা লিখিত ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। রিটার্নিং অফিসাররা তা ইসিতে পাঠাবেন। ঢাকায় নির্বাচন ভবন থেকে ঘোষণা হবে আনুষ্ঠানিক ফল।
প্রতিদ্বন্দ্বী:২৯৯ আসনে এবার নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছেন ১৯৬৯ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৫৩২ জন দেশের ২৮টি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী; বাকি ৪৩৭ জন স্বতন্ত্র। প্রার্থীর মৃত্যুতে পিছিয়ে যাওয়া নওগাঁ-২ আসনে প্রার্থী আছেন আরো দুজন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রেকর্ড ৯৭ জন নারী প্রার্থী রয়েছেন।
# ২৯৯ আসনে এককভাবে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২৬৫ জন (নৌকা ২৭১)। একাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (লাঙ্গল) ২৬৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
# ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পাশাপাশি তাদের শরিক ওয়র্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপির ছয় জন নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা: ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার জেলা এবং ৫৯০ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার উপজেলা পর্যায়ে সার্বিক তত্ত্বাবাধনের দায়িত্ব পালন করবেন। ৪২ হাজার ২৪ জন প্রিজাইডিং অফিসার থাকবেন কেন্দ্রের দায়িত্বে। তাদের অধীনে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৬ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ৫ লাখ ৪২ হাজার ২৫৬ জন পোলিং অফিসার ভোটগ্রহণের মূল কাজটি করবেন।
পর্যবেক্ষক: দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিক মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার পর্যবেক্ষক এবার ভোটের মাঠে নজর রাখবেন।
নিরাপত্তা: ভোটের মাঠের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন।
# সশস্ত্রবাহিনী প্রায় ৩৮ হাজার ১৫০ জন এবং নৌবাহিনী প্রায় দুই হাজার ৮০০ জন।
# প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার পুলিশ; প্রায় ৫ লাখ ১৪ হাজার আনসার ব্যাটালিয়ন।
# বিজিবি ১১৫১ প্লাটুন (প্রায় ৪৪ হাজার ৯ শ জন)
# র্যাবের ৬০০ টিম, রিজার্ভ ৯৫টিম।
# কোস্টগার্ড ৭০ প্লাটুন (প্রায় ২ হাজার ৩শ জন)।
# ভোটকেন্দ্রে ১৫-১৭ জন নিরাপত্তা সদস্য।
# সারাদেশে তিন সহস্র জন নির্বাহী হাকিম এবং সহস্রাধিক বিচারিক হাকিম।
ব্যায়: নির্বাচন পরিচালনা ও আইন শৃঙ্খলা খাত মিলিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রায় সোয়া দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এরমধ্যে পরিচালনা খাতে এক তৃতীয়াংশ এবং নিরাপত্তা খাতে দুই তৃতীয়াংশই ব্যয় হয়ে থাকে।
যান চলাচলে কড়াকড়ি: ভোটের আগে শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) মধ্যরাত থেকে ভোটের পরদিন সোমবার (৮ জানুয়ারি) মধ্যরাত পর্যন্ত বাইক চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। তবে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক বা জরুরি কাজে ব্যবহৃত মোটর সাইকেল চলতে পারবে-এজন্য রিটার্নিং অফিসারের অনুমোদন নিতে হবে এবং স্টিকার প্রদর্শন করতে হবে। একই সঙ্গে ট্যাক্সি ক্যাব, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলাচলও বন্ধ থাকবে শনিবার মধ্যরাত থেকে ভোটের দিন রোববার মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত। শনি ও রোববার ৩২টি লোকাল ট্রেন বন্ধ রাখবে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
২৯৯ আসনে এবার নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছেন ১৯৬৯ জন প্রার্থী।
বিএনপিসহ অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন অর্ধেকের বেশি প্রার্থী। অভিযোগবিদ্ধ ওই নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে।
ওই নির্বাচন ঠেকানোর ডাক দিয়েও ব্যর্থ বিএনপি পরের বছর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর আন্দোলনে নামে; টানা তিন মাসের ওই হরতাল-অবরোধে নাশকতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির মধ্যে তাদের সেই আন্দোলন শেষ হয়।
সংশয় ছিল ২০১৮ সালের আগেও, তবে শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরানোর দাবি থেকে সরে গিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গড়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আসে বিএনপি। কিন্তু ভরাডুবির পর ‘আগের রাতেই’ ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ তোলে দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এসে বিএনপির আন্দোলন আবার বেগবান হয়। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সেই আন্দোলন ২৮ অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পর সহিংস রূপ পয়। হরতাল-অবরোধে ফিরে আসে দশ বছর আগে বিএনপির আন্দোলনের মধ্যে ব্যাপক নাশকতার স্মৃতি।
সেদিনের সংঘাতের পর বিএনপির অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতা কারাগারে, বাকিরাও আত্মগোপনে। রাজপথে তাদের তেমন দেখা না মিললেও ভার্চুয়াল ব্রিফিং করে দেওয়া হচ্ছে হরতাল-অবরোধের ঘোষণা।
এবারও ভোটের আগে সংলাপের আহ্বান এসেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। তবে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ- কোনো পক্ষই তাতে সাড়া না দেওয়ায় ১৫ নভেম্বর তফসিলের হুইসেল বাজিয়ে ভোটের ট্রেন ছেড়ে দেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।
৪ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে শেষ নির্বচনি জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
ভোটের জুয়া
২০১৪ সালে বিএনপি যখন নির্বাচন বর্জন করেছিল, অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, যা নিয়ে এখনও দলটিকে নিন্দা-মন্দ শুনতে হয়। টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা দলটি চায়নি, চতুর্থ দফা সরকারে যাওয়ার সময় সেই সমালোচনা তাদের সঙ্গী হোক।
তাছাড়া এবারের নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য হয়, সেজন্য চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা। ফলে বিএনপিকে ছাড়াও যে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন সম্ভব, তা দেখানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের সামনে।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে আওয়ামী লীগ এবার বেছে নেয় নতুন কৌশল। কোনো আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যাতে একলা পড়ে না যান, সেজন্য মনোনয়নের বাইরে থাকা দলের নেতাদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ খুলে দেওয়া হয়। তাতে রেকর্ড সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা পড়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দপ্তরে।
এখন ৩০০ আসনে চূড়ান্ত ভোটের লড়াই আছেন মোট ১৯৭১ জন। নিবন্ধিত ৪৪ দলের মধ্যে ভোটে আছে ২৮টি। অন্যদিকে বিএনপিসহ ১৫টি দল ভোট বর্জন করেছে।
অর্থাৎ, বর্জনকারীদের প্রায় দ্বিগুণ দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, যেখানে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল মোটে ১২টি দল, সব মিলিয়ে প্রার্থী ছিলেন মোট ১৫৬৭ জন।
গত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় থাকা জাতীয় পার্টিকে নিয়েও ক্ষমতাসীনদের ভাবতে হয়েছে। জাতীয় পার্টি ভোটে না থাকলে লাভ হবে বিএনপির। আবার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য দেখাতে হলে বিরোধী দলও দরকার। সেজন্য জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের জয় সহজ করতে গতবারের মতই ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের শরিকদের দেওয়া হয়েছে ছয়টি আসন, তারা নৌকা নিয়েই ভোট করবেন।
মনোনয়নপর্বে ‘ডামি’ প্রার্থীর কৌশলে নিজেদের মধ্যে কোন্দল এবং সহিংসতার ঝুঁকি ছিল আওয়ামী লীগের সামনে। প্রচার পর্বে সেরকম বেশ কিছু ঘটনা দেখা গেছে, কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে।
স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা কোথাও কোথাও নৌকার মনোনীত প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ হতে পারেন। কিন্তু এ জুয়ায় লাভ হল, নৌকা হেরে গেলেও আওয়ামী লীগই জিতবে।
তিন চ্যালেঞ্জ
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের ফল নিয়ে টান টান উত্তেজনা ছিল। একই রকম পরিস্থিতি ছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময়ও। ভোট গণনার সময় কোনা দল হয়ত এগিয়ে গেছে, পরে আবার অন্যদল তাদের টপকে গেছে।
তবে এবার কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীমের।তিনি বলেন, “এবারের নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা আগে থেকেই টের পেয়ে যাচ্ছি আমরা। কোন দল জিতবে, কোন দল ক্ষমতায় যেতে পারে- এটা অনেকটা স্পষ্ট।”
আলীমের মতে, ভোটার কেন্দ্রে গেল কি না, পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকল কি না এবং ভোট সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হল কি না, সেটাই দেখার থাকবে ভোটের দিন। তার পযর্বেক্ষণ হল- এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার বেশ কিছু ঘটনা হয়েছে। ভোটের দিন জয়ের জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠলে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হবে।
“তফসিল ঘোষণার পরও ভোটে এল না বিএনপি। এখন যা হবার হয়েছে। বিএনপির বর্জনের মধ্যে তো সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তো আর করা গেল না। এজন্য অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা থেকে সরে এলেও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রত্যাশা তো থাকবে। সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।”
আব্দুল আলীম বলেন, ২৮টি দল ভোটে রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছে। কোনো আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ জেতেনি। ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে নানা উদ্যোগও রয়েছে। সেসব সফল হলে কোথাও কোথাও ভালো ভোটার উপস্থিতি হতেও পারে।
“কিন্তু যারা ভোট বর্জন করেছে, তাদের ভোট ব্যাংক রয়েছে একটা, তারা কেন্দ্রে নাও যেতে পারে। আবার যেসব আসনে ভোটাররা আঁচ করতে পারছেন যে তাদের প্রার্থীরা জিতছেই, তাদের অনেকেরও অনীহা থাকবে। সেই সঙ্গে গোলযোগের শঙ্কা থাকলে সব আসনে উচ্চ ভোটার উপস্থিতি নাও হতে পারে।”
২০০৮ সালে শান্তিপূর্ণ ভোটে রেকর্ড ৮৭% ভোটার উপস্থিতি ছিল। বিএনপির বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালে ৪০% এবং সব দলের অংশগ্রহণে ২০১৮ সালে ৮০% ভোট পড়ে।
গ্রহণযোগ্য কতটা হবে?
মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির মনে করেন, নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতিই বলে দেবে– এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে কিনা।
“নির্বাচনের দিন ভোটার যদি কম আসে, তখন প্রশ্ন থাকবে, এরা কি উৎসাহিত না? প্রয়োজন নেই দেখে আসছে না? তারা কি বিএনপির কথা শুনে আসছে না? নাকি তাদেরকে অন্য কোনভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এসব বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, নাকি হয়নি।”
তিনি বলেন, “আগের বছরগুলোতে যে নির্বাচন হয়েছে, এবার আমি সেটা প্রত্যাশা করছি না। একটা গ্রহণযোগ্য ভোট যাতে হয়, সেটাই মূল বিষয়। অনেক জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা তেমন হচ্ছে না। কিছু কিছু জায়গায় আমরা জানি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে, সেখানের রেজাল্ট দেখেই বোঝা যাবে আগে থেকে ঠিকঠাক করে করা হচ্ছে নাকি আসলেই যারা ভোট দিতে আসছে, তাদের ভোট সঠিকভাবে গণনা করা হচ্ছে। এটা নির্বাচনের পরে বোঝা যাবে।”
নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছে কি না, সেই পরীক্ষাও ভোটের দিন হয়ে যাবে বলে মনে করেন খুশী কবির।
উৎকণ্ঠা নিয়ে ‘সুষ্ঠু’ ভোটের পরীক্ষায় বাংলাদেশ
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ মনে করেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে যেভাবে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন, তাতে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।
“সেক্ষেত্রে অবশ্যই ভোটে জনগণের উপস্থিতি অনেক বেশি হবে, মানে আগের যে কোনো নির্বাচনের তুলনায় বেশি হবে। নির্বাচনের পক্ষে জনগণের সম্পৃক্ততা বেশি। ফলে নির্বাচন যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ থাকবে। কিছু বিচ্ছিন্ন সহিংসতা হতে পারে।”
তিনি মনে করেন, কোনো একটি দল নির্বাচনে অংশ না নিলেই যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা হারাবে– তা নয়।
“আমি মনে করছি, গ্রহণযোগ্যতার মূল জায়গাটা হল ভোটারদের অংশগ্রহণ। ভোটারদের অংশগ্রহণ বেশি হলেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে।”
আব্দুর রশীদও মনে করছেন, রোববার ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই এ নির্বাচনের মূল চ্যালেঞ্জ।
“সব রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে আসতো, তাহলে সেটা আরও ভালো হতো। আমি এখন পর্যন্ত দেখছি, নির্বাচন উন্মুক্ত পরিবেশে হচ্ছে এবং দৃশ্যমানভাবে নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু করার জন্য নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে আছে। তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা আমরা করছি।
“সেখানে যদি কেউ অংশ না নেয়, সেটা তার নির্বাচনী কৌশল এবং সেই ফল তাকে ভোগ করতে হবে। কারণ নির্বাচন বর্জনের পক্ষে খুব একটা জনমত দেখছি না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, “একটা অন্যতম বড় দল এবং তার ক্ষুদ্র মিত্ররা নির্বাচনে না আসায় নির্বাচনের সৌন্দর্য খানিকটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে। এটা অনিবার্য ছিল না। তবে এটার জন্য কে দায়ী, সেটা বলতে পারব না।
“যাই হোক, এই খুঁতওয়ালা নির্বাচনটায় যারা এসেছেন, তাদেরকে নিয়ে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যদি ভোটে সহিংসতা করার স্পর্ধা দেখায়, সেটা সরকারি দল, স্বতন্ত্র কিংবা ভিন্ন কোনো দলের হোক কিংবা যারা নির্বাচনে আসেনি, যেই হোক না কেন; তাদের যেন বিনা বিলম্বে শাস্তির আওতায় আনা হয়।”
রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য জনগণকে উৎসাহিত করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, “একটি ভালো সংখ্যার ভোটার যদি ভোট দেয়, তাহলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
ভোটের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে নির্ধারিত সময়ে ভোট আয়োজনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
তিনি বলেন, “নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিগত প্রশ্নে মত-বিরোধের কারণে এবারের নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত সেরকম রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। নির্বাচনী সার্বজনীনতা প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি।”
তারপরও ২৮টি দল এবং ১৯৭১ জন প্রার্থীর অংশগ্রহণে এ নির্বাচনকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও অংশগ্রহণমূলক নয় মর্মে আখ্যায়িত করা যাবে না’ বলে মনে করছেন সিইসি।
১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার ভাষণে যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছিলেন, ভোটের আগের দিনও একই আহ্বান সিইসি রেখেছেন।
তিনি বলেন, “অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু অনস্বীকার্য যে, নির্বাচন প্রশ্নে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ রয়েছে। মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা কাম্য নয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, নাশকতা ও সহিংসতা একেবারেই হচ্ছে না তা বলা যাচ্ছে না।
“রাষ্ট্রীয় ধন-সম্পদের ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে। নির্দোষ, নিরীহ, নিষ্পাপ শিশু, নারী, পুরুষের মর্মান্তিক ও মর্মন্তুদ মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। চলমান এহেন পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান ও অবসান প্রয়োজন। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে। আজকে না হলেও ভবিষ্যতের জন্য।”
হাবিবুল আউয়াল বলেন, “আমরা সবসময় বিশ্বাস করি, আলাপ-আলোচনা ও গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হয়ে যে কোনো রাজনৈতিক সংকটের নিরসন সম্ভব।”
সবাইকে নিয়ম মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রার্থী ও ভোটার সবাইকে নির্বাচন বিষয়ক বিধি-বিধান অনুসরণ করতে হবে। দায়িত্ব পালনে অবহেলা, শৈথিল্য, অসততা ও ব্যত্যয় ‘সহ্য করা হবে না’। কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশীশক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার ‘কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে’।
“তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রার্থিতা তাৎক্ষণিক বাতিল করা হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্র বা নির্বাচনী এলাকার ভোট গ্রহণ সামগ্রিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে। জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল প্রকারের নির্বাচনি অনিয়ম-অনাচার প্রতিহত করার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।”
এআর
আপনার মতামত লিখুন :