ঢাকা : আগের মেয়াদেও মন্ত্রিসভায় বড় বদল এনে নতুনদের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন; টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে গিয়ে এবারও নতুনদের বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নতুন মন্ত্রিসভায় যে ৩৬ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১৪ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী প্রথমবারের মতো দায়িত্ব পাচ্ছেন। একেবারেই এসব নতুন মুখের পাশাপাশি এর আগে বিভিন্ন সময় মন্ত্রিসভায় থাকা আরও পাঁচজনকে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।
বুধবার (১০ জানুয়ারি) রাতে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভায় ডাক পাওয়াদের নাম ঘোষণা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন; বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে শপথ হবে তাদের। সংবাদ সম্মেলনে তাদের নাম প্রকাশের আগে এই ৩৬ জনকে টেলিফোন করে আমন্ত্রণ জানানোর কথা জানান তিনি।
তৃতীয় মেয়াদে বর্তমান সরকার গঠনের সময় ২০১৯ সালে প্রবীণদের অধিকাংশই বাদ পড়েছিলেন; ৪৭ জনের মধ্যে ২৭ জন সেবার প্রথম মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০০৯ সালের মন্ত্রিসভার চারজনকে সেবার ফিরিয়ে এনেছিলেন শেখ হাসিনা।
এবার ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের চতুর্থ মেয়াদের মন্ত্রিসভায় একেবারে নতুনদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ; মৌলভীবাজার-৪ আসনের সাতবারের এ এমপি জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পিকারও ছিলেন।
এক সময় তার একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে এবার মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন শেখ হাসিনা; ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের তিনবারের এ সংসদ সদস্য একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানকে পূর্ণ মন্ত্রী করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসা এই নেতা ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য।
এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও ঋণখেলাপির কারণে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুস সালামের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিল নির্বাচন কমিশন। পরে উচ্চ আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে ভোটের বৈতরণী পার করা এ সংসদ সদস্যকে পূর্ণমন্ত্রী করছেন শেখ হাসিনা।
এর আগে দশম সংসদে ময়মনসিংহ-৯ আসনের এমপি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা।
রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুল হাকিমকে পূর্ণ মন্ত্রিত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় এনেছেন শেখ হাসিনা। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজবাড়ী-২ আসনের পাঁচবারের সংসদ সদস্য।
এক সময়ের উপমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীকে পূর্ণ মন্ত্রিত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়েছেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এবং পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া সংগঠক।
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা সাবের চৌধুরী ২০১৪ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদে আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
২০০১ সালের অক্টোবর থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৬-২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ছিলেন সাবের।
২০০৮-২০১৩ মেয়াদে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার ১০ বছর পর জাহাঙ্গীর কবির নানককে পূর্ণ মন্ত্রিত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে এনেছেন শেখ হাসিনা।
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান নানক বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।
ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে নতুন করে মন্ত্রিসভায় এনেছেন শেখ হাসিনা। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছেলে পাপন বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
নতুন মন্ত্রিসভায় চমক হিসেবে এসেছে বাংলাদেশে পোড়া রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে পরিচিত নাম অধ্যাপক ডা. সামন্তলাল সেনের নাম। টেকনোক্র্যাট কোটায় পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন দেশের বার্ন ইনস্টিটিউটগুলোর জাতীয় এই সমন্বয়ক।
২০১৪ থেকে পাঁচ বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে আবারও মন্ত্রিসভায় ফেরানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে সেই সময়ে বেশ আলোড়ন তুলেছিলেন তখনকার পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা।
২০০৯ সালের সরকারে বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বিমান পরিবহনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ফারুক খানকে ১০ বছর পর আবারও মন্ত্রিসভায় ফিরিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য একাদশ সংসদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন।
পুরনোদের মধ্যে খুলনা-৫ থেকে টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আবার মন্ত্রিসভায় ফিরছেন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এ রাজনীতিককে আবার মন্ত্রিসভায় ফিরিয়েছেন শেখ হাসিনা।
প্রধান শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করা নারায়ণ চন্দ্র ছয়বার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে উপ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদে যান। পরে ২০০৮ থেকে টানা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। দশম সংসদে প্রথমে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। পরে ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছায়েদুর হক মারা গেলে তিনি পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
গত পাঁচ বছর শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা তরুণ নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে পূর্ণমন্ত্রী করছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি চট্টগ্রামের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে। তিনি দ্বাদশ সংসদে দ্বিতীয়বার চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
নতুন প্রতিমন্ত্রী যারা : বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমিকে প্রতিমন্ত্রী করে মন্ত্রিসভায় আনছেন শেখ হাসিনা। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের বড় বোন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করা রিমি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।
নতুন প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ২০২৩ সালের উপনির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আরাফাত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন তিনি।
আরাফাত সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের একজন সিন্ডিকেট সদস্য ও ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান উপদেষ্টা।
নতুন প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন পটুয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতা মুহিব্বুর রহমান মুহিব। জেলার কলাপাড়ার ধুলাসারের আলহাজ্ব জালাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মুহিব পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
তিনি কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ও আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এবার দ্বিতীয়বারের মতো পটুয়াখালী-৪ আসনের এমপি হয়েছেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় ডাক পাওয়া নতুনদের মধ্যে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি থেকে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য। ২০১৪ সালে তিনি প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রত্যাবাসন শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের বিষয়ে টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান করা হয়।
১৯৯৯-২০০১ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলীর মেয়ে রুমানা আলী টুসিকে প্রতিমন্ত্রী করে মন্ত্রিসভায় আনছেন প্রধানমন্ত্রী।
গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে সাতবারের এমপি রহমত আলী স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও ছিলেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের প্রয়াত এই সদস্যের আসনে প্রার্থী হয়ে প্রথমবারের মতো সংসদে এসেছেন তার মেয়ে টুসি।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শফিকুর রহমান চৌধুরী উপমন্ত্রী হয়ে মন্ত্রিসভায় যাচ্ছেন। নবম সংসদের এই সদস্য ১০ বছর পর এবার আবার সংসদে ফিরেছেন।
টাঙ্গাইল-৬ আসনের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটুকে প্রতিমন্ত্রী করে মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ঢাকা-৯ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের ছেলে।
শিক্ষাজীবন শেষে ব্যবসা শুরু করা টিটু ১৯৯৩ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যপদ পান। ২০১৩ সালে তিনি দেশের প্রধান এ স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
আওয়ামী লীগের টাঙ্গাইল জেলা শাখার শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক টিটু ২০১৮ সালের নির্বাচনেও টাঙ্গাইল-৬ আসন থেকে সংসদ নির্বাচিত হন।
এমটিআই