ঢাকা: টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারতের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ।
দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছে। পাশাপাশি ভারতের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আইনি লড়াইয়ের জন্যও তৈরি হচ্ছে।
ভারতের শিল্প মন্ত্রণালয় গত ২ জানুয়ারি ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’ বা ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল’ নামে একটি শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই উদ্যোগ বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে।
টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবসায়ীসহ জিআই বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, অধিকারকর্মীরা বলছেন, টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। ভারতে ‘টাঙ্গাইল’ নামে কোনো এলাকা নেই। তাই ভারতের উদ্যোগ অন্যায্য।
ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নজরে আসে।
এরপরই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নড়েচড়ে বসে। দ্রুততার সঙ্গে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শাড়ির জিআইয়ের আবেদন হয় ৬ ফেব্রুয়ারি। তা গ্রহণ করে সেদিনই গেজেটের জন্য বিজি প্রেসে পাঠায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। এই প্রতিষ্ঠানই পণ্যকে জিআই হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ভারতের জিআই আইন অনুযায়ী, কোনো পণ্যের জিআই নিয়ে কারও আপত্তি থাকলে তা তিন মাসের মধ্যে জানাতে হবে। সে অনুযায়ী আগামী ১ এপ্রিলের মধ্যেই বাংলাদেশকে ভারতের কাছে এই আপত্তির বিষয়টি জানাতে হবে।
ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের এমন অনেক পণ্য ও স্থান আছে, যেগুলোর বাংলাদেশের সঙ্গে মিল আছে। এসব সমনামী পণ্য হিসেবে পরিচিত। এসব সমনামী পণ্য নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা করে সমাধান করা যায় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. তৌহিদুল ইসলাম।
তার মতে, ‘ভারতীয় টাঙ্গাইল শাড়ির নিবন্ধন সনদ বাতিলের জন্য ভারতীয় জিআই রেজিস্ট্রারের কাছে এবং প্রয়োজনে তিন মাসের মধ্যে তাদের অ্যাপিলেট বোর্ডে যাওয়া যায়। তবে বর্তমানে অ্যাপিলেট বোর্ড বাতিল হওয়ায় হাইকোর্ট আপিল শুনতে পারেন। এ ছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিরোধ নিষ্পত্তি পর্ষদেও যাওয়া যেতে পারে। এর পেছনে জোর কূটনৈতিক তৎপরতারও দরকার।’
এই কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে ৫ মার্চ দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেয়। এক পৃষ্ঠার এ চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি জেলা।
এই জেলা ঐতিহাসিকভাবে তার অনন্য ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’র জন্য বিখ্যাত। টাঙ্গাইল শাড়ির এই সুনির্দিষ্ট বয়নের ধরন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকতে পারে। কারণ, ভারতভাগের সময় শাড়ির কিছু তাঁতি ও উৎপাদক এই অঞ্চল থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান।
টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইয়ে ‘টাঙ্গাইল’ নামটি অনন্য হওয়ায় এই একই নাম দুটি দেশের পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে ভবিষ্যতে বিভ্রান্তি ও ভুল-বোঝাবুঝি হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে যে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আছে, সেই চেতনায় এই সমস্যার মীমাংসা করা দরকার।’
বাংলাদেশের চিঠিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে যেন তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে এবং টাঙ্গাইল শাড়ি নামে জিআই নিবন্ধনটি যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাহার বা স্থগিত করে।
পারস্পরিক আলোচনা বা দুই দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করে বিষয়টির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলেও বাংলাদেশ চিঠিতে উল্লেখ করে।
ডিপিডিটির মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের গর্বের বিষয়। এটি কোনোক্রমেই ভারতের হতে পারে না। আমরা তাই এর জিআই নিয়ে সচেষ্ট। এর জন্য আইনিসহ সব স্তরের তৎপরতাই চলছে।’
টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিয়ে সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সরকার আইনি লড়াইয়ের জন্য তৈরি হচ্ছে। এ জন্য সোমবার শিল্প মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠন করে।
ওই টাস্কফোর্স যে কাজ করবে, তার মধ্যে আছে টাঙ্গাইল শাড়ির ‘বিরোধ নিষ্পত্তিতে’ কূটনৈতিক সমাধানের জন্য প্রস্তাব তৈরি। এ ছাড়া ভারতে টাঙ্গাইল শাড়ি নিবন্ধনের বিরুদ্ধে আপিল ও নিবন্ধন বাতিল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সহায়তা প্রস্তাব তৈরি। আবার আপিল ও নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে মামলা পরিচালনার কাজও করবে এই কমিটি।
এআর
আপনার মতামত লিখুন :