ঢাকা : বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে দুদেশের মধ্যে যে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হয়েছে, সেটি দূরে ঠেলে ‘আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু।
মঙ্গলবার (১৪ মে) ঢাকায় গুলশানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসায় নৈশভোজে যোগ দিয়ে এ কথা বলেছেন তিনি।
মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের ওই নৈশভোজের পর এক ব্রিফিংয়ে ‘অনানুষ্ঠানিক’ আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান রহমান।
আলোচনায় র্যাব ও পুলিশের বিশেষ এ ইউনিটের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচনে বাধাদানকারীদের ওপর বিধিনিষেধ, রোহিঙ্গা, শ্রম আইন নিয়েও কথা হয় বলে জানান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি যে, আমাদের সাথে উনাদের সাথে যেন সম্পর্কটা আরও ভালো হয়। উনারা সে কথাটাই বলেছেন।
উনি ইংরেজিতে কথাটা বলেছেন যে, উই ওয়ান্ট টু রিবিল্ড দ্য ট্রাস্ট। এটাই হল-আমার মনে হয়, খুবই উনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, যা বলেছেন। আমরাও প্রতি উত্তরে বলেছি, আমরাও সেটাই চাই। আমরাও একই জিনিস চাই।
তবে নির্বাচনের আগে-পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টানাপড়েন সেটাকে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হিসেবে অভিহিত করলেও বিষয়টি আলোচনা ওঠেনি বলে দাবি করেছেন সালমান রহমান।
এদিন সকালে তিন দিনের সফরে ঢাকায় নামেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু। রাতে গুলশানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান রহমানের বাসায় নৈশভোজের মধ্য দিয়ে তার সরকারি কর্মসূচি শুরু হবে।
এর আগে বিকালে তিনি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতিবিনিময় সভা করেন। ঢাকার আমেরিকান ক্লাবে এক অনুষ্ঠানেও যোগ দেন লু।
নৈশভোজে সালমান রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের বোর্ড সদস্য রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি দলে ডনাল্ড লুর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর চিফ অব স্টাফ নেইট হাফট, রাজনৈতিক ইউনিটের প্রধান সারাহ এল্ডরিস, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সেলর আর্তুরো হাইন্স ও পলিটিক্যাল অফিসার ম্যাথ্যু বেহ।
নৈশভোজ শেষে উপদেষ্টা সালমান সফরকারী লু ও প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে বলেন, প্রথমত উনারা যেটা বলেছেন যে, উনারা চাচ্ছেন ইলেকশনের পরে আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা ভালো করতে চান। উনারা যে কথাটা বলেছেন, অনেকগুলি খাতে আমাদের সাথে কাজ করতে চায়।
আমরাও সেটা উনাদেরকে স্বাগত জানিয়েছি। আমরা বলেছি যে, আমরাও সেটাই চাই। নির্বাচনের আগে আমাদের একটু উনাদের সাথে কিছু ভুল বোঝাবুঝি বলতে পারি বা যাই হোক, ওই কথাটা উনারাও তোলেন নাই, আমরাও তুলি নাই।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আস্থার ঘাটতি তাহলে কোথায় ছিল, এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা বলেন, উনি একটা কথা বলেছেন, আমরা বলেছি ‘ইয়েস, আমরাও চাই।’ ওটাতেও আমি জিজ্ঞেস করব না উনাকে, কেন মনে করেন যে, ট্রাস্ট ডেফিসিটটা কোথায় আছে?
কিন্তু আমরা সবাই জানি, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত, নির্বাচনের পরেও উনাদের তরফ থেকে একটা রিজার্ভেশন ছিল, নির্বাচনের সময়ে। কিন্তু তারপর প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন চিঠি লিখলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। সেটার পরে আমরা ভাবলাম যে, নির্বাচনটা তারা মেনে নিয়েছে। আমাদেরকে, সরকারকেও তারা মেনে নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠিটা তো আপনারা দেখেছেন, খুবই একটা পজিটিভ চিঠি ছিল। তারপর থেকে আমরা এনগেজমেন্ট শুরু করে দিয়েছি উনাদের সাথে।
বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ভিসা বিধিনিষেধ ওরাও তোলে নাই, আমরাও তুলি নাই। ভিসা নিষেধাজ্ঞা তো শেষ হয়ে গেছে।
এখন ভিসা বিধিনিষেধ তো তাদেরকে দেওয়া উচিত বিএনপির উপরে, সহাস্যে বলেন সালমান রহমান।
র্যাব এবং সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি আলোচনায় তোলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, র্যাবের নিষেধাজ্ঞার সাথে সাথে আমাদের বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরীর কথাটাও আমরা বলেছি, তাকে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে।
সে সেখানে বলছে যে দুটা ইস্যু- র্যাব এবং রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার বিষয়টা- তাদের বিচার বিভাগে এটা আছে। বলেছে, এখানে কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগ, আমাদের হোয়াইট হাউজ, পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে স্বাধীন। স্বাধীনভাবে কাজ করে বিচার বিভাগ। তো, তারা বলেছে, আমরা এটা পুশ করতেছি। বলেছে যে, পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে আমরা পূর্ণ সমর্থন এখন দিচ্ছি।
ডনাল্ড লুর আগের সফরে র্যাবের উন্নতির প্রশংসা করার কথা তুলে ধরে সালমান বলেন, র্যাব অনেক উন্নতি করেছে সেটা গতবারই জনসম্মুখে বলেছে।
তো, পররাষ্ট্র দপ্তরের কথাটা হল-আমরা আমাদের তরফ থেকে বলেছি যে, উন্নতি হয়ে গেছে, এখন তোমাদেরকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া উচিত। হোয়াইট হাউজ থেকেও বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগের একটা প্রক্রিয়া আছে। সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ চলছে। সেই আশাবাদী যে, এটা হবে।
বাংলাদেশের শ্রম আইন ও নীতি নিয়ে আলোচনার কথা তুলে ধরে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশের সমঝোতা হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।
একসময়ে আইএলও’র মধ্যে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাবিগুলোর মধ্যে একটু আলাদা ছিল। এখন বলেছে, আমরা একদম একই অবস্থানে চলে এসেছি। ‘তোমরা যদি আইএলও’র সাথে সম্পর্ক করে নিতে পার, আমরা দ্রুত ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন-ডিএফসি শুরু করতে চাই’। আমরা অনেক অগ্রগতি করেছি। শ্রম আইন ও আইনটা পরিবর্তনে। আইএলও’র সাথে আমরা আলাপ-আলোচনা করতেছি, আশা করি সমঝোতাটা হয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিদ্যুতের আনা-নেওয়ায় ভুটান, নেপাল ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ’কানেক্টিভিটির’ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নৈশভোজে আলোচনা করেছে বলেও জানান সালমান রহমান।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে তিনি বলেন, সেটা বলেছে যে, আমরা চেষ্টা করতেছি। আবার বলেছে, আমরা সবাই জানি মিয়ানমারের বর্তমান যে অবস্থাটা ওখানে, সেখানে সময় লাগবে। বলে, আমরা সবাই কাজ করতেছি। চেষ্টা করতেছি।
নৈশভোজের পর পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের পরে এই প্রথম আসলেন। আমরা সম্পর্কের প্রায় সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। উনারা দুদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।
এমটিআই