ঢাকা : ভারতে হত্যার শিকার বাংলাদেশের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যায় কলকাতায় সিআইডির এফআইরে অভিযুক্ত করা হয়েছে সাতজনকে। তবে প্রাথমিক অভিযোগপত্রে আরও অভিযুক্তদের থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না দেশটির সিআইডি।
সিআইডির এফআইরে অভিযুক্ত হিসেবে নাম রয়েছে- আমানুল্লাহ সায়েদ, শিলাস্তি রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সাল আলী শাহী, জিহাদ ওরফে জুবের, সিয়াম হোসেইন এবং আখতারুজ্জামান শাহিন (সবার নাম পাসপোর্ট অনুযায়ী) এবং 'অন্যান্য'।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩৬৪, ৩০২, ২০১, ১২০বি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। সিআইডি বলছে সঞ্জীবা গার্ডেনের ডুপ্লেক্স ফ্লাটের মেইন ফ্লোরের বাথরুমে এমপি আনোয়ারের দেহ টুকরো টুকরো করা হলেও রক্ত ছড়িয়ে ছিলো ঘরের চারিদিকে।
ফ্ল্যাটের মূল দরজার চার ফুটের মধ্যে পাওয়া গেছে প্রথম ব্লাড স্যাম্পল, দ্বিতীয় ব্লাড স্যাম্পল পাওয়া গেছে মাত্র ছয় ফুট দূরত্বে। অভিযুক্তদের প্রত্যেকের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। ফরেনসিক টেস্টের রিপোর্ট যা আসুক একাধিক সাক্ষীর বয়ান ইতোমধ্যেই রেকর্ড করেছে তারা।
সিআইডির দাবি ভারতের ইতিহাসে কলকাতার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অন্তত তিনটি গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। এফআইআরে একটি গাড়ি সব থেকে বেশি ব্যবহার হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এমনকি লাশ ফেলার ক্ষেত্রেও এই গাড়িটি ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাড়িটির ড্রাইভার সিদ্ধার্থ কুণ্ডুকে অন্তত ৭০ ঘণ্টা পুলিশি জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে তাকে এখনো গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
এছাড়া গ্রেপ্তার করা হয়নি এমপি আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকেও। এই দুইজনকেই সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করতে চায় সিআইডি। এই দুইজনের দেয়া প্রাথমিক তথ্যে পুলিশি তদন্ত এগিয়েছে দ্রুতগতিতে। গোয়েন্দা সূত্রে দাবি দুইজনের দেয়া তথ্য যাচাই করে কখনোই ভুল পায়নি তারা।
এছাড়াও গোপাল বিশ্বাসের বরানগরের বাড়ি থেকে নিউটাউনের অ্যাক্সিসমল পর্যন্ত যে হোন্ডা আমেজ গাড়িটি এমপি আনার ব্যবহার করেন তার ড্রাইভার নাজিব খানকেও একাধিকবার জেরা করা হয়, তবে তাকে গ্রেপ্তার করেনি সিআইডি। সূত্রের খবর তাকেও সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করতে চাই সিআইডি।
সিআইডি বলছে ড্রাইভার নাজিব সিআইডিকে দেয়া নিজের জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন নিউমার্কেটের প্লাজা হোটেল থেকে এমপি আনারকে বরানগরের বাড়ি থেকে নিউটন অ্যাক্সিসমল পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য তার গাড়িটি বুক করেন মূলত ফয়সাল। এই প্লাজা হোটেলেই মে মাসের ২ তারিখ থেকে অবস্থান নিয়েছিলো ফয়সাল এবং মোস্তাফিজুর। ফয়সাল ড্রাইভার নাজিবের পূর্ব পরিচিত না হলেও সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাকে চিহ্নিত করেন নাজিব। একইভাবে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গোপাল বিশ্বাস ও ফয়সালকে চিহ্নিত করেছেন।
সিআইডির আরেক সাক্ষী বীরেন ভদ্র। যিনি মূলত বাড়ি ঘরের দালাল হিসেবে কাজ করেন নিউটাউন এলাকায়। খুব কম সময়ে আখতারুজ্জামান শাহিনকে সঞ্জীভা গার্ডেনের ডুপ্লেক্স বাংলোটি খুঁজে দেন বীরেন ভদ্রই। তাকেও ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার জেরা করেছে সিআইডি। জেরায় স্বীকার করেছে তিনিই আমানুল্লাহর জন্য সিদ্ধার্থর গাড়িটিও ভাড়া করে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সঞ্জীভা গার্ডেনের সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী শেষবার ১৩ তারিখ দুপুর তিনটা ১০ নাগাদ এমপি আনার, ফয়সাল এবং আমানুল্লাহকে এই গাড়িতে করেই বিইউ ৫৬ টাওয়ারে ঢুকতে দেখা যায়।
পুলিশের দাবি জেরায় সিদ্ধার্থ আরও জানিয়েছেন এমপি আনারকে ফ্ল্যাটে নামিয়ে দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকেল চারটে নাগাদ ফ্ল্যাট থেকে বেশ উত্তেজিত আতঙ্কিত অবস্থায় নেমে আসেন ফয়সাল। গাড়িতে উঠেই তাকে অ্যাক্সিসমলের সামনে নামিয়ে দিতে বলেন। সঞ্জীভা গার্ডেন থেকে অ্যাক্সিস মলের সামনে গিয়ে নেমে পড়েন ফয়সাল।
এদিকে ফোন পেয়ে ফের ফাঁকা গাড়ি নিয়ে সিদ্ধার্থ আসেন সঞ্জিভা গার্ডেনে। পরে আমানুল্লাহকে নিয়ে আবারও যান অ্যাক্সিসমলের সামনে। এখানেই ফয়সাল এবং আমানুল্লাহ বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেন। এরপর আমানুল্লাহ সিদ্ধার্থের গাড়িতে সঞ্জীভা গার্ডেনে ফিরে এলেও ফয়সাল আর ফেরেননি।
পুলিশের তরফে পরিচয় না জানানো হলেও সিদ্ধার্থর বয়ানের সত্যতা মেলে পিন্টু দাস নামে ওই আবাসনের অপর এক কর্মকর্তার বয়ানের সঙ্গে। সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে পিন্টু জানান আখতারুজ্জামান গত ছয় বছর আগে ওই ফ্ল্যাটটি নিয়েছেন। অন্য সময় ফাঁকা পড়ে থাকলেও বিগত এক থেকে দেড় মাস ধরে ওই ফ্ল্যাটে থাকছিলেন জিহাদ। জিহাদের সঙ্গী হয়েছিলেন আরেক অভিযুক্ত সিয়ামও। ফ্ল্যাটের সিসিটিভি ফুটেছে মিলেছে তাদের ছবি। সিআইডি কাছে পিন্টু দাস এই মামলায় তাদের অন্যতম সাক্ষী।
সিদ্ধার্থর বয়ান অনুযায়ী জিহাদকে চিনার পার্কের ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে আখতারুজ্জামান সোজা চলে যান বিমানবন্দরের কাছে ওটু রেস্টুরেন্ট এন্ড বারে। এখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন শিলাস্তি রহমান ও অন্যনরা। সিআইডির দাবি এই ওটু রেস্টুরেন্ট এন্ড বারেই ডিনার টেবিলে অনারকে খুনের ফাইনাল ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছিল আখতারুজ্জামান।
সিদ্ধার্থর দাবি ডিনার শেষে আখতারুজ্জামান, সিয়াম, জিহাদকে সঞ্জীবা গার্ডেনের আবাসনে নামিয়ে দেন তিনি। এরপর ১৪ তারিখের আগে আর কখনোই জিহাদ তার গাড়িতে ওঠেননি।
এদিকে মামলা শুরু থেকে শিলাস্তি রহমান প্রসঙ্গে পুলিশ এবং ডিবির ধারণা ছিল তিনি খুন সম্পর্কে জানতেন না। খুন হওয়ার আগে বা পরে ফ্ল্যাটের উপস্থিত ছিলেন মাত্র।
কিন্তু আদালতে দাখিল করা পুলিশি তথ্য অনুযায়ী শিলাস্তি শুধুমাত্র আখতারুজ্জামানের সঙ্গে খুনের পরিকল্পনার অংশই ছিলেন না, লাশের টুকরো ফ্ল্যাটের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও অন্যতম ভূমিকা ছিল শিলাস্তি এবং আমানুল্লাহর।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :