ঢাকা : ‘কত কষ্ট হইরা, সুদে টাহা নিয়া জমিটুক (৩১ শতাংশ) কিনছিলাম। হেই জমিটুক দিয়া আসা নাগছে।’-কথাগুলো বলছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বড়খোলা গ্রামের সরস্বতী রায় (৬২)। তিনি অভিযোগ করেন পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ তার জমি জোর করে স্বল্পমূল্যে কিনে নিয়েছে।
জমি কে নিয়েছে? স্বরসতী রায়কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন,‘বেনজীর নিছে।’ বেনজীর কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় পুলিশ’।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির প্রায় সবই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা বলছেন, জমি বিক্রি ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় ছিল না। ভয় দেখিয়ে, জোর করে এবং নানা কৌশলে তাঁদের কাছ থেকে জমিগুলো কেনা হয়েছে।
বেনজীরের কাছে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে গিয়ে জমি বিক্রি করা হিন্দু পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের জমি কিনতে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়োজিত রেখেছিলেন বেনজীর আহমেদ। বেনজীর পরিবারের রিসোর্টের নির্মাণকাজের তদারক করতেন পুলিশ ও র্যাবের কিছু সদস্য। তাদের দিয়ে তরমুজ চাষসহ কৃষিকাজও করানো হয়েছে। মাঠপর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশ দিলে কিছু করার থাকে না।
জমি বিক্রেতারা জানান, যারা বিক্রি করতে রাজি হতেন না, তাদের ক্ষেত্রে আরেক কৌশল নিতেন বেনজীরের লোকেরা। সেটি হলো ওই জমির আশপাশের জমি কিনে নিয়ে সেখানে যেতে বাধা দেওয়া। এর ফলে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হতেন সাধারণ মানুষেরা। মাদারীপুর রাজৈরের কদমবাড়ী ইউনিয়নের বড়খোলা গ্রামের ১২ জন জমি বিক্রেতার সবাই এভাবে তাঁদের জমি বিক্রিতে বাধ্য করার কথা বলেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে এখন পর্যন্ত ৬২১ বিঘা জমির খোঁজ পাওয়া গেছে, যার ৫৯৮ বিঘা গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ও মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। উপজেলা দুটি পাশাপাশি। আর বেনজীর পরিবারের জমিও দুই উপজেলার সীমান্তঘেঁষা এলাকায়। ওই এলাকার গ্রামগুলো হিন্দু অধ্যুষিত।
বেনজীর আহমেদ সেখানে সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক নামে একটি রিসোর্ট করেছেন। এই রিসোর্টে মানুষকে থাকার জন্য কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়। ১০০ টাকা দিয়ে প্রবেশ করে ঘুরেও দেখা যায়। রিসোর্টটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভেতরে খামার, নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা, শিশুদের খেলার জায়গা ও হেলিপ্যাডসহ নানা স্থাপনা রয়েছে।
সাভানা ইকো রিসোর্টের কাছে একটি চায়ের দোকানে পাওয়া যায় বৈরাগীরটোলা গ্রামের তরুণ সঞ্জয় বলকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তার পরিবারের ৩০ বিঘার বেশি জমি জোর করে কিনে নিয়েছেন বেনজীর। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যখন এই জমি বেচাকেনা হয়, তখন বেনজীর র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।
রিসোর্টটি পড়েছে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম বৈরাগীরটোলায়। ওই গ্রাম ও পাশের ডোমরাশুর গ্রামে গত মঙ্গলবার গিয়ে জমি বিক্রেতা পরিবারগুলোর ২৭ সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মধ্যে ২৫ জনই বলেছেন, তারা জমি বিক্রি করতে চাননি, বাধ্য করা হয়েছে। তাদের ভয় দেখিয়েছেন পুলিশের পরিদর্শক তৈমুর ইসলাম।
গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বেনজীরের পক্ষে জমি কেনার কাজ করার সময় তৈমুর খুলনা মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে নিয়মিত গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে গিয়ে বেনজীরের পক্ষে জমি কেনার কাজ করতেন।
গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে বেনজীর পরিবারের জমি কেনার কাজ করা পুলিশ পরিদর্শক তৈমুর ইসলাম ১৯৯৫ সালে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। পুলিশ সূত্র জানায়, রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় কর্মরত থাকাকালীন ২০০২ সালের জুনে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে তিনি বিভাগীয় মামলায় জিতে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) যোগ দেন। ২০১৩ সালের জুনে তিনি পরিদর্শক হন।
দর্নীতির অভিযোগে ২০২১ সালের মার্চে তৈমুরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছিল দুদক। মামলায় তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, খুলনার সহকারী পরিচালক তরুণ কান্তি ঘোষ জানান, মামলাটিতে এখনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
এমটিআই