ঢাকা : বুধবার (৫ জুন) পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা : অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী মঙ্গলবার (৪ জুন) সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বুধবার (৫ জুন) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পরিবেশ মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেরেবাংলা নগরে মেলা চলবে আজ থেকে ১১ জুন পর্যন্ত।
তবে এমন ঘটা করে পরিবেশ দিবস পালনে সবাই যখন ব্যস্ত। তখন প্রকাশেই চলছে বৃক্ষ নিধন। এখানে সরকারি আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো হিসাব নেই। যা আছে তা হলো, গাছ কাটা হচ্ছে। তাতে বিপন্ন হয়ে পড়ছে অন্যান্য প্রাণীকূল। এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কাজে-অকাজে যখন-তখন কাছ কাটার ফলে পরিবেশ দিন দিন তপ্ত হয়ে উঠছে। লম্বা সময় ধরে গাছ কাটা, বন উজাড়ের ফল এখন ভোগ করতে শুরু করেছে দেশের মানুষ। বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য দরকার আইন ও মহাপরিকল্পনা।
সম্প্রতি প্রকাশিত রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর তথ্য। বিগত ১৪ মাসের গাছ কাটার তথ্য বের করেছে সংস্থাটি। তাদের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উন্নয়নের কারণে এ সময়ে ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৫টি গাছ কেটেছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে চট্টগ্রামে ৫ লাখ ৬ হাজার ২২২টি।
দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নীলফামারী, সেখানে কাটা হয়েছে ৪ লাখ ১৫২টি গাছ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা কক্সবাজারের ১০ হাজার গাছে পড়েছে কোপ। সবচেয়ে কম, একটি গাছ কাটা হয়েছে রংপুরে।
প্রতি মাসে গড়ে ৮৮ হাজার ১৯০টি এবং দৈনিক কাটা পড়েছে প্রায় ২ হাজার ৯০২টি। ঢাকায় গত এক বছরে মোট ১ হাজার ৮১টি গাছ কাটা হয়। মাসে ৮৩টি এবং প্রতিদিন প্রায় তিনটি করে গাছ কাটা পড়ে। এর মধ্যে ধানমন্ডিতেই কাটা হয়েছে ৫০০। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটা হয়েছে ৫৫০।
সংরক্ষিত বনে গাছ ধ্বংস করা হয়েছে ৭ লাখ ৬ হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় সরংক্ষিত বনের পাঁচ লাখ গাছে উন্নয়নের কোপ পড়েছে। এক বছরে বন বিভাগ গাছ কেটেছে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৭৭৩টি।
এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, মৌলভীবাজার রেল কর্তৃপক্ষ, কুষ্টিয়া পৌরসভা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসন, নড়াইল জেলা পরিষদ, খুলনা সিটি করপোরেশন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন, হবিগঞ্জ পৌরসভা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), সিলেট সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ গাছ কাটায় জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আরডিআরসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমরা প্রতিবেদন তৈরিতে দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের সংবাদ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। বড় গাছ কাটা হলে সংবাদ হয়। ছোট গাছপালা কাটার খবর গণমাধ্যমে আসে না। আমাদের প্রতিবেদনে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাছ কাটার তথ্য দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গাছপালা কাটার পেছনে উন্নয়ন প্রকল্পই সবচেয়ে বেশি দায়ী। নীলফামারীতে তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য চার লাখের মতো গাছ কাটা পড়েছে। ঢাকায় ধানমন্ডিতে ৫০০টির মতো গাছ কাটা হয়েছে সড়ক সৌন্দর্যের জন্য। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাড়াতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০০টির বেশি গাছ কাটা পড়েছে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও কক্সবাজারের মহেশখালীর সংরক্ষিত প্যারাবনে সাত লাখের বেশি গাছ কাটা হয়েছে। এসব বন্ধ না হলে খুব শিগগিরই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবো আমরা।
এদিকে এই বিশাল গাছ কাটার পেছনে একটি অর্থনৈতিক বিষয়টিও জড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন নামে এই বাণিজ্য চলছে। খোদ বনবিভাগের দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন অনেকে।
জানা গেছে, সামাজিক বনায়ন বিধিমালার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে দেশের নানা প্রান্তে কেটে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার গাছ। তা আবার ব্যক্তিপর্যায়ে নয়, খোদ বন বিভাগ মেতেছে গাছ নিধনের এ ধ্বংসযজ্ঞে। এতে ছায়াবঞ্চিত হচ্ছে মানুষ, ঠিকানা হারাচ্ছে পাখপাখালি। বন বিভাগ বলছে, নিয়মমাফিক ও নির্দিষ্ট সময়ের পর এসব গাছ কাটা হচ্ছে। এটি সামাজিক বনায়নের অংশ। গাছ কাটার পর সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে ফের গাছ লাগানো হয়।
বন বিভাগের ২০২৩ সালের ২৩ আগস্টের সামাজিক বনায়নের হালনাগাদ তথ্যে উঠে এসেছে গাছ কেটে টাকা আয়ের ফিরিস্তি। এতে দেখা গেছে, সামাজিক বনায়নের আওতায় ১৯৮১-৮২ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৬ হাজার ১৪৮ হেক্টর উডলট বাগান এবং ৮০ হাজার ১৪১ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকে ৫৪ হাজার ৬৬৩ হেক্টর উডলট এবং ৩৫ হাজার স্ট্রিপ বাগান কাটা হয়েছে, যার বিক্রয়মূল্য ১৯৪৮ কোটি ৬০ লাখ ১২ হাজার ১৫৩ টাকা। তবে কতটি গাছ কাটা হয়েছে, সে তথ্য পাওয়া যায়নি।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক বনায়নে গাছ রোপণের ২০ বছর পর তা কেটে নিয়ম অনুযায়ী বিক্রি করার বিধান রয়েছে। গাছ বিক্রির টাকা বন অধিদপ্তর ১০ শতাংশ, ভূমি মালিক সংস্থা ২০ শতাংশ, উপকারভোগী ৫৫ শতাংশ, ফের বাগান করার জন্য ১০ শতাংশ এবং ইউনিয়ন পরিষদ পাবে ৫ শতাংশ।
বন বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন বিভাগ সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে উপকারভোগীকে উৎসাহিত করতে ২০ বছরের পুরোনো গাছ কেটে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। তবে যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়, বছর বছর তার চেয়ে বেশি গাছ লাগানো হয়। ২০০৯-১০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ লাখ ১৭ হাজার ৪০২ হেক্টর ব্লক, ৩০ হাজার ২৫২ সিডলিং কিমি স্ট্রিপ বাগান সৃজন এবং ১১ কোটি ২১ লাখ চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৯ হাজার ৮৫৩ হেক্টর উপকূলীয় বনায়ন সৃজন করা হয়েছে। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৩০ হাজার একর বনভূমি দখলমুক্ত করে বনায়ন করা হয়েছে। এ বছর বর্ষা মৌসুমে সারাদেশে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ২৭ হাজার চারা রোপণ করা হবে।
অন্যদিকে গাছ কাটার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ভিন্ন মত জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী আমিরুল রাজীব বলেন, সামাজিক বনায়ন বিধিমালার এ নিয়ম এখন পরিবর্তন প্রয়োজন। এমন নিয়ম করতে হবে, গাছ কেটে উপকারভোগীকে আর টাকা দেওয়া হবে না। গাছের পরিচর্যা কিংবা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা উপকারভোগীকে অন্য সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. শাহরিয়ার জামান বলেন, সামাজিক বনায়নের সুফল ভোগ করে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ। এর সুফল ভোগ করে সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। ২০ বছরের পুরোনো গাছ যদি কেটে ফেলা হয়, সে অবস্থায় আবার ফিরে আসতে ২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর একটা গাছ বড় হলেই সেটা বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে, এমন মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। গাছের যে বাস্তুসংস্থানবিষয়ক মূল্য আছে, সেটা চিন্তা করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশে বন আইন, ১৯৮৭ আছে। ‘গাছ কাটা যাবে না, কাটলে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে’– এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া সরকার ২০১৬ সালে প্রস্তুত করে। সে আইন মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত হয়ে যখন সংসদে গেছে, তখন বলা হলো, এমন কোনো আইন আলাদা করে প্রয়োজন নেই; বরং বিদ্যমান বন আইনের অধীনে বিধিমালা করে এটা করা সম্ভব। আমাদের কথা, যেভাবে সম্ভব, সেটাই করেন। আর বসে থাকবেন না।
এমটিআই