• ঢাকা
  • সোমবার, ০১ জুলাই, ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১
যুক্তরাজ্যে যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীনকে নিয়ে রায়

‘দুঃসহ যন্ত্রণার ওপর নতুন কষ্ট’


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ২৯, ২০২৪, ০৯:২১ এএম
‘দুঃসহ যন্ত্রণার ওপর নতুন কষ্ট’

যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের ঘাতক যুক্তরাজ্যে পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। ফাইল ছবি

ঢাকা : নৃশংস হত্যাকাণ্ডে স্বজনদের বিদায়ের কষ্ট নিয়ে দীর্ঘ ৪২ বছর অপেক্ষার পর যুদ্ধাপরাধে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনদের বিচারে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন একাত্তরের শহীদ পরিবারের সন্তানরা; কিন্তু পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের সাজা কার্যকর না হওয়ার দুঃখবোধ তাদের যায়নি।

এর মধ্যেই যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক এক রায় তাদের বয়ে চলা দুঃসহ যন্ত্রণার ওপর নতুন কষ্ট আর অপমানজনক অভিজ্ঞতা হয়ে এসেছে, যা মেনে নেওয়া যায় না বলে মন্তব্য তাদের।

এ রায় বিভ্রান্তিমূলক এবং একাত্তরে আক্রান্ত পরিবারের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক, বলছেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহীদ রেজা নূর।

বুদ্ধিজীবী ঘাতক মুঈনুদ্দীনের মামলা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে এ রায় মনকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্তান শমী কায়সারেরও।

শহীদ পরিবারের সন্তানদের জন্য তো বটেই এ রায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে কোনো নাগরিক ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিও অবমাননাকর বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।

ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের এমন রায়ের পর এ মামলার বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

একই দাবি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার সংগঠনগুলোর।

বাংলাদেশের একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ’রেওয়াজ’ ভেঙে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের এমন রায়কে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরস ফোরামের একজন নেতা এ বিষয়ে সরকার যাতে ’চুপ’ না থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয় তেমন পদক্ষেপ চান।

অপরদিকে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি এ নিয়ে ভেবে-চিন্তে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সরকার ‘যথাযথ পদক্ষেপ’ নিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের গত ২০ জুনের এ রায়ে আবার সামনে আসে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে দেশটিতে পালিয়ে থাকা যুদ্ধরাপরাধী মুঈনুদ্দীনের বিষয়টি।

সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও শহীদুল্লাহ কায়সারসহ ১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ২০১৩ সালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যদণ্ড দেয় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীন ১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে পলাতক। বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশটির নাগরিকত্ব পান ১৯৮৪ সালে।

সম্প্রতি ওই রায়ে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন এই যুদ্ধাপরাধী। মুঈনুদ্দীনের ফৌজদারি অপরাধের বিবরণসহ মন্ত্রণালয়ের ওই নথিতে তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এ নিয়ে তার করা মানহানি মামলার রায়ে ১১ বছর আগে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ‘নানা সমালোচনা ও কটূ’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে।

একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন আল-বদর বাহিনীর হয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে যুদ্ধপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পান চৌধুরী মুঈনুদ্দীন।

২০১৯ সালে যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীনের ফৌজদারি অপরাধের বিবরণসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল সেই প্রতিবেদন তখনকার টুইটার (বর্তমানে এক্স) হ্যান্ডলে শেয়ার করেন।

তবে নিজেকে ‘নির্দোষ’ দাবি করে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে তাকে সরকারি নথিতে চিহ্নিত করায় ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিরুদ্ধে হাই কোর্টে মামলা করেন মুঈনুদ্দীন। পরে তা দুই দফায় খারিজ হলে সুপ্রিম কোর্টে ফের মামলা করার আবেদন করেন এ যুদ্ধপরাধী। গত ২০ জুন যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট তাকে মামলা করার সুযোগ দিয়ে রায় দেয়।

এ রায়ের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট অন্য দেশের আদালতের রায়ের বিষয়ে মন্তব্য না করার ‘রেওয়াজ ও নৈতিক অবস্থান’ থেকে সরে এসেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এ অধ্যাপক বলেন, ব্রিটেনের আদালতের একটা ভালো রেওয়াজ হচ্ছে তারা অন্য কোনো সার্বভৌম দেশের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আদেশ বা রায় দেয় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই রেওয়াজ ভঙ্গ করা হয়েছে এবং এটা খুবই দুঃখজনক।

রায়ের সমালোচনা : বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের (বিলিয়া) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলছেন, যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীনের মামলা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট যে কথাগুলো বলেছে, তাতে তাদেরই একটা নৈতিক পরাজয় হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়।

নিজেদের প্রতিশ্রুত রীতিনীতি, রেওয়াজ; সেগুলোর বিরুদ্ধে গিয়ে তারা একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার প্রতি যদি কোনো মন্তব্য করে থাকে, সেটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়।

ব্রিটেনের হাই কোর্ট এবং আপিল আদালতে মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার পরও সুপ্রিম কোর্টে এসে এমন সিদ্ধান্ত আসার পেছনে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ থাকার সন্দেহ করছেন তিনি।

অধ্যাপক মিজান বলছেন, ব্রিটেনের হাই কোর্ট এবং আপিল বিভাগ দুই জায়গাতেই (যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীনের মামলা) খারিজ করে দিয়েছে। একজন যেহেতু বিরোধিতা করেছে, সে কারণে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে প্রায় সবাই (বিচারপতি) একই সুরে কথা বলছে। আমি বলব, এটা কৌতূহলের ব্যাপার যে, কোন জ্ঞানে তারা এ জিনিসটা করলেন।

যেটা আদৌ তাদের রিটের অংশই ছিল না। সেখানে অপ্রাসঙ্গিক জিনিসপত্র টেনে নিয়ে এসে কেন আমাদের অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ‘বিতর্কিত’ করতে হবে, তীর্যক মন্তব্য করতে হবে, এগুলো আমার মনে হয় যে রাজনীতির ব্যাপার। সেখানে আইনের দিক থেকে খুব একটা লাভ যে হয়েছে তা কিন্তু নয়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, আমরা জানি যে, চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের মত যারা আছে, তাদের যারা সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে, জামায়াত-শিবির, তারা ইংল্যান্ডে, ওয়াশিংটনে, ব্রাসেলসে প্রতিনিয়িত হাজার হাজার ডলার খরচ করছে; শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য, যারা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত তাদের বাঁচানোর জন্য।

এটা নতুন কোনো খেলা নয়, নতুন কিছু নয়। সমগ্র পশ্চিম তো এখন ডান দিকে ঝুঁকে পড়েছে, ডানের দিকে ঝোঁকার একটা বিষয় এল আমাদের এখানেও।

রাজনীতির কারণেই ‘গণহত্যার স্বীকৃতি’ না দেওয়ার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক মিজান বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যার যে সংজ্ঞা, আইনের যে কোনো সাধারণ ছাত্রই আমাদের এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটা বলতে বাধ্য। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, যারা সংখ্যা বা বিভিন্ন কিছু নিয়ে বিতর্ক তুলছে, তারা আন্তর্জাতিক আইনের সাধারণ সংজ্ঞারই বিরুদ্ধাচারণ করছে।

আপনি যদি জেগে থেকে ঘুমানোর ভান করেন, সেই ঘুম যেমন ভাঙানো যায় না, তেমনি আপনি যদি সত্যকে গ্রহণ না করে সিদ্ধান্ত নেন যে, আমি কখনও মেনে নেব না, তাহলে তো এটা বোঝানো মুশকিল।

রায়ের সমালোচনা করে জেনোসাইড গবেষক ও শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান তৌহীদ রেজা নূর বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য তাদের মামলার প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বাধীন আদালত হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে নানা ‘সমালোচনা ও কটূ মন্তব্য’ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

যুক্তরাজ্য যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে একটি ‘বায়াসড’ ভূমিকা পালন করেছে মন্তব্য করে তিনি বলছেন, চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের পক্ষে যুক্তরাজ্যে রায় হওয়ার ফলে বাংলাদেশের রায়টি লঘু হয়ে গেল বলে ভাবার কোনো কারণ নেই। যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীনকে একাত্তরের পর থেকেই ‘দাগী আসামি’ হিসেবে দোষী সাব্যস্ত না করে যুক্তরাজ্য রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। মুঈনুদ্দীন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না বলে দাবি করে সেখানে ঠাঁই পেয়েছিল। এটি কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। এতে যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন বুদ্ধিজীবীদের ঘাতক মুঈনুদ্দীন। ১৯৮৪ সালে দেশটির নাগরিকত্ব পান তিনি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পরে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের উদাসীনতা ছিল বলে মত তার।

তৌহীদ রেজা বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের একজন সন্তান হিসেবে আমি মনে করি, ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায়টি গ্রহণযোগ্য নয়, বরং এটি যুক্তরাজ্যের রায়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই রায়ের পর যা যা করার ছিল দুই দেশের মধ্যে তা ঠিকমত হয়নি। কেন সেটি হল না, তার একটি সঠিক তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। যাতে সামনে এ ব্যাপারগুলোর সম্মুখীন হওয়ার ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা আছে, তা চিহ্নিত করা যায়।

যে কোনো দেশে কেউ যদি জেনোসাইডের সঙ্গে জড়িত থাকে বা কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িত থাকে, তাহলে তাদের বিচারের আওতায় আনা ও সেই বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা যুক্তরাজ্যের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কারণ এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য অঙ্গীকারবদ্ধ।

যুক্তরাজ্য যেভাবে বিষয়টি চালিত করেছে, তাতে তারা তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করলো। এতে মনে হচ্ছে যে, যুক্তরাজ্য আসলে আন্তর্জাতিক অপরাধকারীদের সহযোগিতা করার একটি রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে। এর বিরুদ্ধে আমরা যারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমাদের এটি মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই, বলছেন তৌহীদ রেজা।

মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারকে হত্যার অভিযোগও প্রমাণিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর আল বদর বাহিনীর হাতে অপহরণ হওয়ার পর থেকে তার আর খোঁজ মেলেনি; লাশও পাওয়া যায়নি।

শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে অভিনেত্রী শমী কায়সার মনে করেন, যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টের এ রায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে কোনো নাগরিকের জন্য অবমাননাকর।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এখন ক্ষমতায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিও এটি অবমাননাকর। বিষয়টি শহীদ পরিবারের সন্তানদের জন্যও অনেক বেশি অবমাননাকর। সারা পৃথিবীতে আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের ধরে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এত বড় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা ঘটল, যেটা প্রমাণিত হল; কিন্তু তার এমন একটা রায় হল।

বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান এখন ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি শমী কায়সার।

তিনি বলেন, পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে একই সাথে বিষয়টিতে কাজ করতে হবে। আমার কাছে মনে হয়েছে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে ডিপ্লোমেটিক নেগোসিয়েশনটা আরও আগে থেকে করা উচিত ছিল। দুই দেশের মধ্যে এই যোগাযোগ স্থাপনটা জরুরি ছিল, কারণ বেশ কয়েক মাস ধরেই আমরা এমন কিছু হতে পারে বলে অনুমান করছিলাম।

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, ব্রিটিশ আদালত তার নিজস্ব সার্বভৌমত্ব নিয়ে কাজ করে আর বাংলাদেশের আদালতও তার নিজস্ব সার্বভৌমত্ব নিয়ে কাজ করে। এখানে যদি এক দেশের আদালত একজনকে বেকসুর খালাস দেয়, আবার অন্য দেশের আদালত সাজা দেয়, এগুলো একেক দেশে ভিন্ন রকম হতে পারে।

কিন্তু যেখানে জেনোসাইডের অভিযোগ আছে, যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে এবং হাই কোর্টের সমপর্যায়ের একটি আদালত (আইসিটি) এই রায় দিয়েছে, সেখানে ব্রিটিশ আদালত কেন কীভাবে করল, আমরা জানি না। এটা কতটা ন্যায়সঙ্গত, সেটাও আমরা জানি না।

সরকারের কী করা উচিত : ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের এমন রায়ের বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের রায়ের বিষয়টি নিয়ে ভেবে-চিন্তে বাংলাদেশকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে হঠাৎ করে কিছু করা যাবে না, অনেক বিচার-বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে কী করা যায়, সেভাবে এগোতে হবে। এ রায় পুরো বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে হেয় করেছে।

এই রায়ের ফলে দেশের বাইরের মানুষের কাছে আমাদের বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের এ আদেশকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে যে নতুন করে আবার একটা বিতর্ক সৃষ্টি করা হবে না, তা বলা যায় না।

কাজেই বাংলাদেশের সরকার, যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার করার ব্যবস্থা করেছে (তার মতে, সরকার মানে বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছায় তো হয়েছে) ব্রিটিশ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করার সুযোগ নাই তাদের।

যুক্তরাজ্যে হওয়া ‘বিভ্রান্তিমূলক’ রায়টি বাংলাদেশের ইতহাস ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে মন্তব্য করে তৌহীদ রেজা নূর বলেন, রায়টি হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সরকারের দিক থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন মঞ্চকে যুক্ত হতে হবে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে প্ল্যাটফর্মগুলো রয়েছে, সেগুলোর সহায়তা নেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) এ ব্যাপারে অনেক দিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারকে তাদেরও পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

হারুন হাবীব বলেন, আমাদের যথাযথ সরকার পর্যায়ে যুক্তরাজ্যের এই আদেশের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তার বিশ্লেষণ করা উচিত। যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সমর্থকেরা যাতে এ আদেশকে ব্যবহার করে নতুন বিতর্ক তৈরি করতে না পারে, কালবিলম্ব না করেই তার পূর্ণ ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে।

এটা বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক যে কার্যক্রম, সেটাকে নতুন করে বিতর্কে আনার একটা চেষ্টা। বাংলাদেশ সরকারের চুপ করে থাকার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।

রায়ের বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম-আইসিএসএফ এর ট্রাস্টি রায়হান রশিদ।

সেই উদ্যোগ কী হতে পারে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, উচিত সরকারের উচিত প্রথমে যুক্তরাজ্যের সিনিয়র প্রফেশনালদের (আইন বিশেষজ্ঞ) মতামত নেওয়া। তারপর সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ রায়ের দুদিন পর ২২ জুন ঢাকায় হতাশা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন সংগঠনও।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, প্রজন্ম ৭১ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তান) ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিবৃতিতে মুঈনুদ্দীনের মানহানির মামলায় তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুক্তরাজ্যে দক্ষ আইনজ্ঞ নিয়োগ করার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

এ রায় নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও হত্যাশা প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম-আইসিএসএফ।

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ ও ন্যায় বিচারের পক্ষে কাজ করা আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত সংগঠনটি বলেছে, যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্ত গণহত্যার দায়ে চিহ্নিত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে তাদের ভোগ করা দায়মুক্তি অবসানের জন্য বাংলাদেশ এবং এর জনগণের কয়েক দশকের প্রচেষ্টাকে অবমূল্যায়ন করেছে।

একই সঙ্গে বিষয়টি অপরাধীদের হাতে গণহত্যার শিকার হয়ে জীবন দেওয়া এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল বলে মনে করছে সংগঠনটি।

যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তটি ভুল পথে চালিত, ভ্রান্ত ও মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভর করে দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে সংগঠনটি বিবৃতিতে এ মামলার বিষয়ে যুক্তরাজ্যে আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশ সরকারের যুক্ত না হওয়ার বিষয়ে উষ্মাও প্রকাশ করেছে।

কী করবে সরকার : ব্রিটিশ হাই কমিশনার সারাহ কুকের সঙ্গে সাক্ষাতে মুঈনুদ্দীনের মামলার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপই নেবে।

গত পরশু দিন (২৫ জুন) ব্রিটিশ হাই কমিশনার এসছিলেন। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কী কী পদক্ষেপ নেব তাকে জানিয়েছি।

কী পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, যথাযথ পদক্ষেপই আমরা নেব। তবে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেটা নেওয়ার পরে আপনাদেরকে জানাব।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে আইনি ও কূটনৈতিক পথে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার কাজ চলছে।

কূটনৈতিক তৎপরতা কী হতে পারে, সে বিষয়ে এক প্রশ্নে কোনো কিছু খোলাসা করেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। শুধু বলেছেন, আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সূত্র : বিডিনিউজ

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!