ঢাকা : মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে হাই কোর্টের দেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে টানা বিক্ষোভের সপ্তম দিনে সকড়-মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।
রোববার (৭ জুলাই) বিকাল থেকে সড়ক আটকে মানুষকে ভুগিয়ে রাতে উঠে গেলেও একই কর্মসূচি নিয়ে সোমবারও রাস্তায় ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
তবে সরকার এ কর্মসূচির কোনো ‘যৌক্তিকতা’ দেখছে না। কোটা বহালের সিদ্ধান্ত যেহেতু হাই কোর্ট থেকে এসেছে, এর কোনো সমাধান থাকলে সেটাও সেখান থেকে আসা উচিত বলে মনে করছেন শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা।
কোটা বাতিলের পুরনো পরিপত্র বহাল করার দাবিতে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। এ দিন ছিল সনাতম ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা, যা দক্ষিণ ঢাকার বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
দুই কর্মসূচিতে স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকার যানবাহনের চাকা। রাস্তায় নেমে গন্তব্যে পৌঁছাতে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ঢাকার বাসিন্দাদের, যার রেশ ছিল রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত।
কোটাবিরোধীদের অবরোধ দেখা যায় সাভার এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের কুমিল্লা মহাসড়কেও। ফলে দূরপাল্লার যাত্রীদেরও যানজটের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হল। এখন থেকে মেধারভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে।
তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল থাকবে বলে ওই পরিপত্রে বলা হয়।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।
গত ৫ জুন কোটা পুনর্বহাল করে রায় দেয় হাই কোর্ট। ওই দিনই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ করে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা। ১ জুলাই থেকে তারা টানা বিক্ষোভ করছেন।
এরই মধ্যে ৪ জুলাই কোটা পুনর্বহালে হাই কোর্টের রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দেয় আপিল বিভাগ। সেদিন থেকেই কোটা বাতিলের আন্দোলন জোরালো হয়।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে কোটাবিরোধী আন্দোলন দেখছে দেশ। রোববারের মত যানজট পরিস্থিতি সোমবারও হবে কিনা, সেই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে রোববার দুপুর ২টার পর ঢাকার শাহবাগ, ইন্টারকন্টিনেন্টাল ক্রসিং, সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়, আগারগাঁও সিগন্যাল, চানখাঁরপুলে হানিফ ফ্লাইওভারে নামার মুখের রাস্তাসহ আশপাশেল কয়েকটি সড়ক অবরোধ করেন কোটাবিরোধীরা।
শিক্ষার্থীরা ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেন।
প্রায় ৫ ঘণ্টা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সাতটি রাস্তার মোড় আটকে রাখার পর রাত ৮টার দিকে রাস্তা ছাড়েন আন্দোলনকারীরা। যাওয়ার আগে সোমবার ফের অবরোধের ঘোষণা দিয়ে যান।
সোমবারও তারা সারাদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের পাশাপাশি বিকাল সাড়ে ৩ টা থেকে অবরোধ কর্মসূচি পালন করবেন।
এই কর্মসূচির কারণে যে যানজট হতে পারে, সে বিষয়ে শনিবার রাতেই ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সকর্ত করা হয়েছিল। রোববার সকালেও এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান।
ঢাকার সড়ক-মহাড়ক রোববার যানবাহনের স্বাভাবিক চাপে কখনও কখনও তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে দুটি কর্মসূচিতে এ দিন দুপুরের পর প্রায় অচল হয়ে যায় ঢাকা।
রাত সাড়ে ৯টায় যুগ্মকমিশনার মেহেদী হাসান বলেন, নগরবাসীকে আগেভাগেই কিছু তথ্য দিয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি আমরা। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ যানজটের রেশ কেটে গেছে। আমিসহ আমাদের অফিসাররা দিনভরই মাঠে ছিলেন। সবাই মিলে চেষ্টা করেছি পরিস্থিতি সহনীয় করার।
সোমবার (৮ জুলাই) আবার আন্দোরনকারীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ নিয়ে রাস্তায় নামছে। এ বিষয়ে ট্রাফিক বিভাগের প্রস্তুতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমরা মাঠেই থাকব। আর আন্দোলনের বিষয়টি দেখবে আমাদের অপরাধ বিভাগ। আমরা যানচলাচল ম্যানেজ করার চেষ্টা করব, যাতে মানুষ দুর্ভোগে না পড়ে।
সোমবারের কর্মসূচি ঘিরে নগরবাসীর জন্য কোনো বার্তা আছে কিনা, জানতে চাইলে এস এম মেহেদী হাসান বলেন, আমরা তো ওভাবে বলতে পারি না। এ মুহূর্তে বলতে পারি, যারা শাহবাগের দিকে আসবেন তারা যেন হাতে সময় নিয়ে বের হন।
কোটাবিরোধী আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করছে সরকার : কোটাবিরোধী আন্দোলনে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকে সমর্থন দিচ্ছে। সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে শীর্ষ নীতিনির্ধারকরাও কথা বলছেন।
তাদের বক্তব্য- কোটার বিষয়ে ২০১৮ সালেই সরকার তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল, বাতিল করেছিল। এখন সেটি আদালত ফিরিয়ে আনলে তা আদালতেই নিষ্পত্তি হতে হবে, এখানে সরকারের কিছু করার নেই।
আদালতে বিচারাধীন থাকার কথা বললেও কোটাবিরোধী আন্দোলন পরিস্থিতির ওপর নজর রয়েছে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের।
রোববার (৭ জুলাই) এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ বলে দিয়েছেন, এই আন্দোলনের কোনো ‘যৌক্তিকতা নেই’।
সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতের নিষ্পত্তি করা উচিত বলে মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেছেন, হাই কোর্টের রায়, এটার বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন করা, এটা তো সাবজুডিস। কারণ, আমরা সরকারে থেকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারি না। কারণ, হাই কোর্ট রায় দিলে সেটা হাই কোর্ট থেকেই আবার আসতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, সরকারি চাকরিতে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফেরানোর সিদ্ধান্তে সরকারের কোনো হাত নেই।
শিক্ষার্থীরা যে বিষয়ে আন্দোলন করছে, সে সিদ্ধান্ত সরকারেরই ছিল। আমরা তো এ সিদ্ধান্ত দিইনি, দিয়েছেন আদালত। তারপরও আমরা, আমাদের দেশের ব্যাপার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।
‘ষড়যন্ত্রীরা’ কোটা আন্দোলনের সুযোগ নিতে পারে বলে মন্তব্য করে তাদের সতর্ক থাকার তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে গত ১ জুলাই থেকে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি দল ঢাকার শাহবাগ মোড়ে আন্দোলন করছেন। তাদের সঙ্গে মিল করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও একই কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে।
এমটিআই