ঢাকা : কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বিকালে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা থাকলেও দুপুর থেকে ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বেলা ১১টার পর থেকেই ঢাকার উত্তরার আবদুল্লাহপুর, বাড্ডার প্রগতি সরণি, বনানী, রামপুরা, মুগদা, বিরুলিয়া, উত্তরার বিভিন্ন সড়ক, বিমানবন্দর, নর্দ্দা, মিরপুর-১০ নম্বর, ধানমন্ডির রাপা প্লাজা, যাত্রাবাড়ী এবং মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
ফলে এসব এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচলও। তাতে করে নগরজুড়ে যানজট সৃষ্টির শঙ্কা করছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
শিক্ষার্থীদের অবরোধে ভরদুপুরের প্রচণ্ড গরমে যানজটে আটকে ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। গাড়ি থেকে নেমে অনেকে হেঁটেই গন্তব্যে ছুটছেন।
সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত সাতজন। শিক্ষার্থীরা ঢাকার মহাখালী এবং চট্টগ্রামের কুমিরায় রেললাইন অবরোধ করায় ট্রেন চলাচলও বিঘ্নিত হচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের ঘোষণা ছিল, মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় দেশের সব ক্যাম্পাসে তারা বিক্ষোভ মিছিল করবেন। কিন্তু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এদিন বেলা ১১টার দিকেই বাড্ডায় প্রগতি সরণি অবরোধ করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান ট্রাফিক বিভাগের এডিসি এএসএম হাফিজুর রহমান বলেন, রামপুরা ব্রিজ থেকে বাড্ডা লিংক রোড টু নতুন বাজার রুটে কোনো গাড়ি আসতে পারছে না। এখানে ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা আছেন। পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
ট্রাফিক পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, বনানীর কাকলীতে সড়ক অবরোধ করেছেন প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। তাতে বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাকলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়কে অবস্থান নেয় প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে বনানী বিদ্যানিকেতনের কিছু শিক্ষার্থীকেও দেখা গেছে। তারা কোটা বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন। পাশাপাশি সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার বিচার দাবি করছিলেন।
সড়ক অবরোধের ফলে বিমানবন্দর সড়ক হয়ে মহাখালীমুখী যানবাহন আটকা পড়ে। একই অবস্থায় পড়ে বিমানবন্দরের পথে চলা যানবাহনগুলোও। মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে চলেছেন। দূরের গন্তব্যের যাত্রীরা উপায় না পেয়ে গাড়িতেই অপেক্ষা করছেন।
গাজীপুর পরিবহনের যাত্রী সুরাইয়া বেগম বলেন, প্রায় দুই ঘণ্টা এইখানে আটকায়া আছি। কখন ছাড়বে জানি না। ক্ষুধা লাগছে অনেক। হাইটা যে যামু সেই উপায় নাই, পায়ে ব্যথা। গরমও অনেক বেশি।
দুপুর ১২টার পর সায়েন্সল্যাব মোড়ে ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ এবং বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থীরা অবরোধ শুরু করেন। এতে মিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দুপুর সোয়া ২টার দিকে সেখানে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালালে সংঘর্ষ বাঁধে। দুই পক্ষই পরস্পরের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকে।
সংঘর্ষের মধ্যে সেখানে পাঁচটি হাতবোমা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় সাতজনকে আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, বিরুলিয়া, ধউর, আবদুল্লাহপুর ও মুগদায়ও সড়ক অবরোধ করা হয়েছে। ফলে ওইসব এলাকায় যান চলাচল বন্ধ আছে।
বিরুলিয়ায়, ধউর, আবদুল্লাহপুর, উত্তরার সড়কে ছাত্ররা বসে পড়েছে। মুগদায় বসেছিল তবে উঠে গেছে। এখন যানবাহন কিছুটা চলছে, কিন্তু এমন হলে তো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেছেন, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও ইমপেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা রামপুরা ব্রিজ অবরোধ করায় রামপুরা থেকে আবুল হোটেল হয়ে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া পর্যন্ত এবং অন্যদিকে বাড্ডা লিঙ্ক রোড, হাতিরঝিল সড়ক পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
এছাড়া আশুলিয়ায় বেড়িবাঁধ সড়ক, ঢাকা-আশুলিয়া সড়ক, ইসিবি চত্বর থেকে বিমানবন্দর সড়কের কুড়িল বিশ্বরোড, বিমানবন্দর সড়কের এমইএস থেকে কাকলী, মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সৈনিক ক্লাব পর্যন্ত সড়কে যানজট তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগরের ট্রাফিক বিভাগ।
পুলিশের ওয়ারি ট্রাফিক বিভাগের ডিসি আশরাফ ইমাম জানিয়েছেন, চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে বেলা পৌনে ১১টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী ও দনিয়াতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে রাস্তা অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।
তারা ফ্লাইওভারের পাশের সার্ভিস রোডটিও ব্লক করে রেখেছে। ফলে ফ্লাইওভার দিয়ে যান চলাচল বন্ধ আছে। এছাড়া বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল। পুরো চিটাগাং মহাসড়ক বন্ধ।
মতিঝিলে শাপলা চত্বর এলাকাতেও রাস্তা অবরোধ করতে দেখা গেছে। যাত্রাবাড়ীতে অবস্থান নিয়েছে দনিয়া কলেজ এবং মাহবুবুর রহমান মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ওই এলাকায় যানবাহন চলাচলের জন্য ডেমরা দিয়ে ডাইভার্ট করা হচ্ছে বলে জানান যাত্রাবাড়ী জোনের (ট্রাফিক) সহকারী কমিশনার তানজিল আহমেদ।
শিক্ষার্থীরা মহাখালীতে রেললাইন অবরোধ করায় দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
বিএএফ শাহীন কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি এবং সিভিল অ্যাভিয়েশন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেখানে জড়ো হয়। বেলা ৩টার দিকে পুলিশ গিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে সড়ক ছেড়ে যেতে বলে। তাতে সাড়া না দিয়ে শিক্ষার্থীদের ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
ঘটনাস্থলে আটকে আছে ঢাকাগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস এবং রেলগেইটের অদূরে আটকে আছে রাজশাহীগামী বনলতা এক্সপ্রেস। যাত্রীদের অনেকেই নেমে হেঁটে চলে গেছেন।
চট্টগ্রামের আর্ন্তজাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ অবরোধ করেছেন। ফলে চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া চারটি আন্তঃনগর ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে আটকে আছে।
যা ঘটেছিল : সোমবারের সহিংসতার পর কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ ফের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে।
আগের দিন রাত সাড়ে ৯টায় ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা জানান, মঙ্গলবার বেলা ৩টায় রাজু ভাস্কর্যসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করবেন তারা।
কোটা সংস্কারের এক দফা দাবির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার এবং সোমবারের ঘটনার হামলাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিতে তাদের এ কর্মসূচি।
অন্যদিকে ছাত্রলীগ রাত ১২টার দিকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করবে।
বাঙালির মহান স্বাধীনতাকে ‘কটাক্ষ’, একাত্তরের ঘৃণিত গণহত্যাকারী রাজাকারদের প্রতি ‘সাফাই’, আন্দোলনের নামে ‘অস্থিতিশীলতা’ তৈরি এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ও নেতাকর্মীদের ওপর ‘বর্বর হামলার প্রতিবাদে’ এই বিক্ষোভ সমাবেশ হবে বলে ছাত্রলীগের ভাষ্য।
২০১৮ সালে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা দুই সপ্তাহ ধরে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে সরকারপ্রধান বলেন, কোটা আন্দোলন করার আগে তো তাদের রেজাল্টগুলো দেখা উচিত ছিল যে- কোথায় তারা দাঁড়িয়েছে! দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?
ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই বক্তব্য নিয়ে রোববার রাতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গভীর রাতে বিক্ষোভে নামেন। সেখানে স্লোগান দেওয়া হয়, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’।
এরপর সোমবার পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ।
একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে এবং পরে আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় ছাত্রলীগ। পিটুনিতে আহত হয়ে প্রায় তিনশ শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান, তাদের মধ্যে ১২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়া হয়।
সংঘর্ষ ও হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জোরালো অবস্থান নিতে দেখা যায়; রাতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে।
সন্ধ্যার কিছু আগে পুলিশ এসে হলগুলোতে অবস্থান নিলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ফিরতে থাকেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও ক্যাম্পাসের মধ্যে দল বেঁধে অবস্থান নেন। রাতে বিভিন্ন হলে তাদের তৎপরতা বাড়তে দেখা যায়।
অপরদিকে দফায় দফায় সংঘর্ষের পর কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটি অংশ জোট বেঁধে শহীদ মিনারের দিকে রওনা দেয়। পরে তারা পুলিশের বাধার মুখে পড়ে।
পুলিশের বাধায় বেশিদূর যেতে না পারে কার্জন হলের কাছে সড়কে আন্দোলনকারীরা হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে।
এমটিআই