• ঢাকা
  • সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১
কোটা আন্দোলনে প্রাণহানি

সুষ্ঠু তদন্তে জাতিসংঘের উদ্যোগ চান ৭৪ নাগরিক


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ৩০, ২০২৪, ১০:৩৭ এএম
সুষ্ঠু তদন্তে জাতিসংঘের উদ্যোগ চান ৭৪ নাগরিক

ঢাকা : সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনে প্রাণহানি ও সহিংসতার ঘটনায় স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৭৪ জন নাগরিক। তারা বলেছেন, ‘এই বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের।’

দেশবাসীকে কঠিন আত্মপ্রত্যয়ে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে ‘সক্রিয় ও দায়িত্বশীল’ ভূমিকা পালনের আহ্বানও জানান এই নাগরিকেরা।

সোমবার (২৯ জুলাই) এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গত ১৬ জুলাই থেকে পুলিশসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী এবং তাদের পাশাপাশি সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রীর প্ররোচনায় তাদের আশির্বাদপুষ্ট ছাত্র সংগঠনের সহিংস কর্মীরা নজিরবিহীন দমনপীড়নের তাণ্ডব চালিয়েছে।’

ছাত্র আন্দোলনকে সরকারি দল ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘বিরোধী পক্ষও তেমনি ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতির নামে একে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছে।’  

ছাত্র-জনতা হত্যা ও জনগণের সম্পত্তি বিনষ্টের নাশকতার পেছনে যেকোনো ধরনের অপরাজনীতির নিন্দা করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সরকারের বল প্রয়োগে কমপক্ষে দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সহিংস ঘটনায় হতাহতের মধ্যে কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন। হতাহতের তালিকায় সংবাদকর্মীরাও আছেন।’  

‘হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক ব্যাপক, ভয়াবহ’ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমের ওপর সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কারণে আমরা জানতে প্রকৃত সংখ্যা জানতে পারছি না।’

সরকারকে দায়ী করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সাংবিধানিক শপথ এবং আইন উপেক্ষা করে একাধিক মন্ত্রী যেভাবে চরম দায়িত্বহীন ভাষায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর তাদের সমর্থক ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে দেশ ও বিদেশে বাংলাদেশের জনগণ ও দেশের শুভকাঙ্ক্ষীরা স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘কারফিউয়ে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ, জাতিসংঘের লোগো সম্বলিত সাঁজোয়া যান রাস্তায় নামানো, সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীকে (বিজিবি) নিয়োজিত করা, হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি করারও অভিযোগ রয়েছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।’

আন্দোলন চলাকালে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, এসব ক্ষতি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

বিবৃতি এসব নাশকতার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী শাস্তির দাবি জানানো হয়। তবে এই অজুহাতে ভিন্নমতের কাউকে দমন-পীড়ন বা সাধারণ মানুষকে হয়রানি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

‘নাশকতার সময় সরকার তা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি’ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সরকারি বাহিনীগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের এই ভূমিকার রহস্য উদঘাটন এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা জরুরি।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘প্রাণহানি, ছাত্র-জনতার ওপর গুলির তদন্ত না করে পুলিশ শুধু নাশকতার মামলা করে হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা লোককে আসামি, কয়েক হাজার লোককে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে অসংখ্য নিরীহ নাগরিক, শিক্ষার্থী কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।’

শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীদের কয়েকজনকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও আনা হয় বিবৃতিতে। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হাসপাতাল থেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়াকে ‘অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও নিপীড়নমূলক’ বলেও মন্তব্য করা হয়।

পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য বাহিনী ‘ব্লক রেইড’ ও নির্বিচার গ্রেপ্তার করে জনমনে, পরিবারগুলোতে এবং তরুণ সমাজের মনে ‘সীমাহীন ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার’ করেছে অভিযোগ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার বদলে আরও জটিল ও অশান্ত করে তুলবে।

নাগরিকদের এ বিবৃতিতে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো—

১. আন্দোলনকালে পুলিশ, র‌্যাব, অন্যান্য বাহিনী বা সরকারের মদদপুষ্ট বেসরকারি অস্ত্রধারীদের হাতে শিক্ষার্থী, শান্তিপ্রিয় নাগরিক, কিশোর-কিশোরী এমনকি শিশু নিহত, নির্যাতিত ও আহত হওয়ার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করতে হবে।

স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে এই তদন্ত করার স্বার্থে এটি জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে হওয়া জরুরি বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বানও বিবৃতিদাতারা।

২. যারা নিহত, গুরুতর আহত হয়েছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় শোক পালনের ঘোষণা দিতে হবে। এই ঘটনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত কত লোক, শিক্ষার্থী, কিশোর-কিশোরী নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা, নাম পরিচয় সরকারকে অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে।

নিহত, আহত ও নিপীড়নের শিকার মানুষদের স্মরণে, তাদের প্রতি সহমর্মিতা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য একটি জাতীয় নাগরিক শোক সভা আয়োজনে দেশের সব ‘বিশিষ্ট ও দায়িত্বশীল’ নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

৩. কোনো কিছুতে মানুষের জীবনের ক্ষতিপূরণ হয় না উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, তারপরও এই দায় সরকারকে মেনে নিয়ে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যারা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন, চোখ, হাত, পা হারিয়েছে তাদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।

৪. কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক, সংগঠক, শিক্ষার্থী ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ কাউকে কাউকে আটক করে যে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছে, তা সংবিধানের লঙ্ঘন ও ফৌজদারি অপরাধ সমতুল্য।

এসব অশুভ তৎপরতা বন্ধ করে, গণরুম ও ‘টর্চার সেলকেন্দ্রিক’ নির্যাতনের অবসান ঘটানোর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নিয়ে সরকারকে শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।

নির্বিচার গ্রেপ্তার, আটক ও ‘আটক রেখে বিবৃতি আদায়’, দমন-পীড়ন, শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের স্বজনদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, পুলিশ ও র‌্যাবের ‘লাগামহীন হয়রানি’ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

৫. স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে কারফিউ তুলে নিতে হবে। দেশের ছাত্র-জনতাকে দমন-পীড়ন কিংবা ভয়-ভীতি প্রদর্শনের জন্য যেসব সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সরঞ্জাম রাস্তায় নামানো হয়েছে, অবিলম্বে তা স্ব স্ব স্থানে ফেরত নিয়ে যেতে হবে।

অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে ইন্টারনেটের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের অবসান করতে হবে। ভিন্নমতের মানুষকে হয়রানি ও তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে।

বিবৃতিতে যারা সই করেছেন : মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, হামিদা হোসেন, খুশী কবির, মেঘনা গুহঠাকুরতা, শামসুল হুদা, ফস্টিনা পেরেইরা, রুশাদ ফরিদী, নুর খান, রেজাউল করিম চৌধুরী, জাকির হোসেন, মাহিন সুলতানা, তাসনিম সিরাজ মাহাবুব, জাহানারা খাতুন, আরিফা হাফিজ, দীপায়ন খীসা।

অধিকার কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন ফজিলা বানু লিলি, ইশরাত জাহান প্রাচী, মুক্তশ্রী চাকমা, হানা শামস আহমেদ এবং অরূপ রাহী।

আইনজীবীদের মধ্যে রয়েছেন জেড আই খান পান্না, শাহদীন মালিক, সারা হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, তবারক হোসেন, শুভ্র চক্রবর্তী, শরীফ ভূঁইয়া, সাইদুর রহমান, প্রিয়া হাসান চৌধুরী, শারমিন খান।

এনজিও কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন রাশেদা কে. চৌধুরী, শিরিন হক, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বদিউল আলম মজুমদার, শারমিন মুরশিদ।

অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আছেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, হোসেন জিল্লুর রহমান, আনু মুহাম্মদ, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন আসিফ নজরুল, পারভীন হাসান, গীতি আরা নাসরিন, মো. তানজিমউদ্দিন খান, সুমাইয়া খায়ের, মুশতাক এইচ খান, মির্জা তাসলিমা সুলতানা, ফিরদৌস আজিম, বীনা ডি কস্তা, শাহনাজ হুদা, সাঈদ ফেরদৌস, রোবায়েত ফেরদৌস, নোভা আহমেদ, নাভীদা খান, সামিনা লুৎফা, ফারহা তানজীন তিতিল, মাইদুল ইসলাম, রিজওয়ানা করিম, সাইমুম রেজা তালুকদার।

গবেষকদের মধ্যে আছেন রেহনুমা আহমেদ, রেজাউল করিম লেলিন, সাদাফ নুর, নাসরিন খন্দকার, স্বপন আদনান, দীনা সিদ্দিকী, রোজিনা বেগম, বারিশ হাসান চৌধুরী, রেজওয়ান ইসলাম।

এ ছাড়াও সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা নাসের বখতিয়ার, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সাঈদা গুলরুখ, সালিম সামাদ, লেখক আলতাফ পারভেজ, আহমেদ স্বপন মাহমুদও বিবৃতিতে সই করেন।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!