ঢাকা : তীব্র গণ আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কার্যত সরকারবিহীন চার দিনে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সারাদেশে ছড়িয়েছে সহিংসতা।
জেলায় জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি, মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় নেতাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো জেলায় বিএনপি নেতাদের বাড়িঘরেও হামলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) পর্যন্ত ভাঙচুর-লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে কোথাও কোথাও।
হামলা হয়েছে থানাতেও; অস্ত্র লুট, পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হামলা হয়েছে পুলিশ সদস্যদের ওপর। মঙ্গল ও বুধবারেও অনেক জায়গা থেকে পুলিশের লাশ ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এই অবস্থায় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
কয়েকটি কারাগারে বন্দি বিদ্রোহের পাশাপাশি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক দুর্ধর্ষ জঙ্গি, দাগি আসামি পালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অস্ত্র ও গুলি লুট হয়েছে।
বেশ কয়েকটি জেলায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিরূপ পরিস্থিতিতে সংবাদকর্মীরাও নিরাপদ বোধ করছেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের সঠিক ও সব তথ্য সংগ্রহ করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
সারাদেশে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শুক্রবার (৯ আগস্ট) পর্যন্ত অনেক জায়গাতেই ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি খোলেনি। সড়কে মানুষের চলাচল ছিল কম। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাড়িঘর থেকে বের হয়নি।
সন্ধ্যার পর মফস্বলের অনেক সড়কই ফাঁকা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকে এলাকাছাড়া।
অনেক হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা, মন্দির, উপাসনালয় ঘিরে রাতের বেলায় সাধারণ মানুষের পাহারা দেখা গেছে। তাতে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও যোগ দিচ্ছেন। একে ‘আতঙ্কের মধ্যেও ভরসা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা হামলা, সহিংসতার খবর পাঠিয়েছেন।
রাজবাড়ী : সোমবার রাজবাড়ী শহরের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যানার-ফেস্টুন নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাস্কর্য। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে।
একই দিন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলীর বাড়িতেও ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তার গোল্ড এশিয়া জুট মিলেও আগুন দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয়েছে শহরের দুটি ফিলিং স্টেশনও।
গোয়ালন্দ উপজেলার পৌর মেয়র নজরুল ইসলামের বাড়িতেও ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাতে পাংশা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন বিশ্বাসের বাড়িতে লুটপাট করা হয়।
মঙ্গলবার পাংশা পৌর শহরের নারায়ণপুরে সদ্য সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের বাড়িতেও ভাঙচুর-লুটপাট চলে। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ হয় শহরের টেম্পুস্ট্যান্ড এলাকায় পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও।
কুমিল্লা : কুমিল্লায় সোমবার মনোহরগঞ্জের পোমগাঁও গ্রামে সদ্য সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। একই সময় লাকসামের পাইকপাড়া এলাকায় তার ভাতিজা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলামের বাড়িতেও ভাঙচুর-লুটপাট, আগুন দেওয়া হয়।
ওইদিন নগরীর কান্দিরপাড়ে রামঘাট এলাকায় মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। নগরীর মুন্সেফবাড়ি এলাকায় কুমিল্লা সদর আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের বাড়িতেও একই সময় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়।
কান্দিরপাড়ে বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন (টাউন হল) ভাঙচুরের পর আগুন দিয়ে হাজার হাজার বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শতবর্ষী কুমিল্লা ক্লাবেও আগুন দেওয়া হয়।
নগরীর পুলিশ লাইন্সের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে রেশন স্টোরের মালামাল। আগুন দেওয়া হয়েছে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও। সঙ্গে দেবিদ্বার, তিতাস থানায়ও। এসব ঘটনায় পুলিশের গাড়িও পোড়ানো হয়েছে।
মুরাদনগরের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম সরকারের মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ ভবন, মুরাদনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলা হয়েছে। নগরীর টমছমব্রিজ মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স, মুরাদনগর ও কোতয়ালি মডেল থানা, নাঙ্গলকোট থানা ও রেলওয়ে স্টেশন, নাঙ্গলকোট উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, নাঙ্গলকোট পৌর মেয়র আবদুল মালেকের বাসভবন, নাঙ্গলকোট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সামসুদ্দিন কালুর বাসভবন, দাউদকান্দি থানা, লাকসাম পৌর মেয়রের কার্যালয় ও বাসভবনে হামলা-ভাঙচুর লুটপাট শেষে আগুন দেওয়া হয়।
হামলা হয়েছে কুমিল্লা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গাজী গোলাম সারোয়ার শিপনের বাসায়। নগরীর পুলিশ লাইন্সে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় একটি বাড়িতে শিক্ষার্থীরা আশ্রয় চেয়েছিলেন। গ্রিন লিফ স্কুলের সামনের সেই বাড়িটি ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
চাঁদপুর : সোমবার দুপুরে চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নে বিক্ষুদ্ধ জনতার ঢল নামে। কিছুক্ষণ পর বাগড়া বাজারে সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান ও তার ছেলে অভিনেতা শান্ত খানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ফরিদগঞ্জে বিক্ষুব্ধরা থানায় হামলার চেষ্টা করলে পুলিশের গুলি চালায়। এ সময় শাহাদাত নামে এক যুবক নিহত হয়। কচুয়া থানার এসআই মামুনুর রশিদকে কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এ ছাড়া চাঁদপুর সদর মডেল থানা, ফরিদগঞ্জ থানা ও কচুয়া থানায় হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে। চাঁদপুর নৌ-থানায়ও হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুদ্ধ জনতা। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় শহরের নতুন বাজার এলাকার কদমতলা রোডে চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী দীপু মনির বাসভবন।
তার বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জে আর ওয়াদুদ টিপুর জিম সেন্টারে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দুই জায়গাতেই লুটপাট হয়। এর আগেরদিন একই এলাকায় জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
ফেনী : বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) দুপুরে ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের উত্তর জাহানপুর গ্রামে পেয়ার আহম্মদ নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের মদিনা বাজার এলাকায় ৭৫ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্টে হামলা চালানো হয়। এ সময় দেশীয় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করা হয় ১০ নম্বর সিকিউরিটি পোস্টে দায়িত্বরত গার্ড রবিউল ইসলাম ও আনসার সদস্য সাজিদকে। পরে অ্যাডমিন ভবনের জানালা, সরকারি মোটরসাইকেল ও জেসিবির গ্লাস ভেঙে ফেলে।
এ ছাড়া দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি দিদারুল কবির রতনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
খুলনা : কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মোহসিন রেজার উপজেলা সদরের বাসভবনে ঢুকে তাকে পিটিয়ে হত্যার বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে মোহসিন রেজার পুড়ে যাওয়া মরদেহ উদ্ধার হয় বলে তার ভাই জেলা পরিষদের সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন জানান।
সোমবার আনন্দ মিছিল থেকে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে হামলা হয়। আগুন দেওয়া হয় কয়রা সদরে খুলনা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবুর বাসভবনে। উপজেলার গড়িয়াবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক অরবিন্দ মণ্ডল ও সুজিত রায়ের ঘরও ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভিটাভাঙা গ্রামের পঞ্চানন কুমার মণ্ডলের বাড়িতে হামলা হয়েছে। হামলা-ভাঙচুর করেছে তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামিনী বাসিয়া গ্রামের রণজিত কুমার মণ্ডল, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বটবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা নিত্য রঞ্জন কবিরাজ, পঙ্কজ কবিরাজ, তিলডাঙ্গা মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রণজিৎ মণ্ডল ও ভাদলাবুনিয়া গ্রামের সুরঞ্জন মণ্ডলের বাড়িতেও।
একই উপজেলার বাণীশান্তা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পশ্চিম খেজুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুদেব কুমার রায়, ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও আমতলা গ্রামের বাসিন্দা জয়ন্ত কুমার গাইন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক পূর্ব খেজুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জীব মণ্ডলের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে।
মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বিজয় কুমার সরদারের বাড়িও আক্রান্ত হয়েছে।
বিজয় বলেন, মঙ্গলবার সকালে যখন দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়, তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। ঘরের সব মালামাল লুট করে নিয়ে বাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) রাতে পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক কর্মী স্বপন বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। এর আগে বুধবার রাতে সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনে অবৈধভাবে প্রবেশকারীদের কাছ থেকে জব্দ করা নৌকা লুট করার চেষ্টা করা হয় বলে কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা নির্মল কুমার মণ্ডল জানান।
কুষ্টিয়া : সোমবার কুষ্টিয়া মডেল থানায় হামলা-ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের পর অস্ত্র লুট করা হয়। বুধবার কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে বন্দি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। প্রায় অর্ধশত বন্দি পালিয়ে যায়। কুষ্টিয়া-৩ সদর আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
সদর উপজেলার ঝাউদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সদর উদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বাড়ি, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি তাইজাল আলী খান ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহামান আতার, মিরপুর উপজেলায় কুষ্টিয়া-২ এর সংসদ সদস্য কামারুল আরেফিন, দৌলতপুর কুষ্টিয়া-১ আসসের সাবেক সংসদ সদস্য সরোয়ার জাহান বাদশা ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বাড়িতে হামলা হয়েছে।
জেলার বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনায় সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আটজন নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে তত্ত্বাবধাক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গা শহরে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের বিপরীতে কবরী রোডে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের বাড়িতে ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়।
তার ছোট ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও চুয়াডাঙ্গা পৌর সভার সাবেক মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটনের বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেও চলে লুটপাট।
রেজাউল করিম লিটন নামে স্থানীয় এক সংবাদকর্মী বলেন, দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা পৌর শহরে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের বাসভবন এবং দর্শনা পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম ফারুক আরিফের বাড়িতে হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
দর্শনা থানা কিংবা থানা এলাকার কোনো পুলিশ ক্যাম্পে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি বলে দর্শনা থানার ওসি বিপ্লব কুমার সাহা জানিয়েছেন।
তবে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের ও চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা শহরের সিনেমাহল পাড়ার বাসিন্দা মানজার আলী জোয়ার্দ্দার বলেন, সিনেমা হলপাড়ায় জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরেফিন আলম রঞ্জুর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা। এ ঘটনায় চারজন আগুনে পুড়ে মারা যান।
আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপকমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালার শহরের সিনেমা হলপাড়ার রাজনৈতিক কার্যালয়েও ভাঙচুর, আগুন ধরিয়ে দেওয়া ও লুটপাট করা হয়েছে।
এসব সহিংসতার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষক লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দাকে গত ৬ অগাস্ট বিকালে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বলে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি শেখ সেকেন্দার আলী জানান।
বাগেরহাট : বাগেরহাটের শরণখোলা প্রেসক্লাবে বুধবার রাতে ভাঙচুর ও দুই সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হয়। হামলায় আহত প্রেসক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন লিটন ও সাধারণ সম্পাদক মহিদুল ইসলামকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
শরণখোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন লিটন বলেন, ৫০-৬০ জনের লাঠিসোঁটা হাতে ভেতরে ঢুকে হামলা শুরু করে। তারা প্রেসক্লাবের কম্পিউটারসহ নানা আববাসপত্র ভাঙচুর করে চলে যায়।
এ ছাড়া সদর উপজেলার ডেমা এলাকার একাধিক মাছের ঘেরে লুটপাট চালানো হয়েছে বলে ওই কয়েকজন ঘের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় হামলা, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য পুলিশ সদস্য খুন হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশ নিজেই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে।
পটুয়াখালী : সোমবার বিক্ষুব্ধ লোকজন সদর রোডে জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর করে আগুন দেয়। শহরের ফোর লেনের সোনালী ব্যাংক সংলগ্ন মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. তানভীর হাসান আরিফ, কাজীপাড়া সড়কের এসপি কমপ্লেক্স শপিং মল ও কলাতলা বালুর মাঠ সড়কের ব্যবসায়ী কার্যালয়ে।
সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মো. মিজানুর রহমান মনির খাঁর বাসভবনেও হামলা হয়েছে।
গলাচিপায় সাবেক সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদার বাসভবন ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়, রাঙ্গাবালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সাইদুজ্জামান মামুন খানের বাসা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর হয়। কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও পৌর মেয়র বিপুল হালদারের বাসায় হামলার পাশাপাশি লুটপাট হয়েছে।
হামলা ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে গলাচিপা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অমি গাজীর ব্যবসায়ী কার্যালয়। বাউফল উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশবিদ্যালয়ের ভিসি স্বদেশ চন্দ্র সামন্তর বাসায় ভাঙচুর হয়েছে। দুমকী উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল কালাম আজাদের বাসবভনের হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। দুমকি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাওছার আমিন হাওলাদারকে মারধর করা হয়েছে।
বুধবার রাতে হামলা চালানো হয়েছে মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী বাজারের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কিছু ব্যবসায়ীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িত। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয় এবং সব সরকারি-বেসরকারি কার্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ঝালকাঠি : সোমবার আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমুর ঝালকাঠি শহরের রোনালসে রোডের বাসভবনে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস ওই বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বাংলাদেশি ও বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে।
আগুন দেওয়া হয় জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান আরিফুর রহমানের কলেজ রোডের বাড়িতে।
সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আল মাহামুদের মালিকানাধীন শহরের কলেজ রোডের কমিউনিটি সেন্টার ও ডিসি অফিসের সামনের কার্যালয়ে ভাঙচুর চলে। জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও পৌর কাউন্সিলর কামাল শরীফের বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
জেলা শহরে শহরের কাপুড়িয়াপট্টিতে প্রবীর হালদারের চালের গোডাউনে ভাঙচুর চালিয়ে চাল নিয়ে যায়।
প্রবীর হালদার বলেন, আমার গোডাউনে শুধু ২২০০ বস্তা চালই ছিল। গোডাউন ভাঙচুর করে একদল লোক প্রায় সব কিছুই নিয়ে যায়।
ঝালকাঠি-১ আসনের সংসদ সদস্য সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের মালিকানাধীন জেলার রাজাপুর উপজেলার বাইপাস মোড়ের ব্যক্তিগত অফিসও দখল করা হয়েছে।
রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট খাইরুল আলম সরফরাজ, সাবেক রাজাপুর উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আহসান হাবিব রুবেল, যুবলীগ নেতা রতন বিশ্বাস, রবী দাস ও স্বপন সমাদ্দারের ঘর বাড়িতে হামলা ও তাদের কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
নলছিটিতে স্থানীয় সাংবাদিক ইব্রাহিম খান শাকিল দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হন। উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও উপজেলা বিএনপি নেতা সৈয়দ আবদুল কাইয়ুমের ব্যক্তিগত অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর লুটপাট হয়।
শেরপুর : সারাদেশে চলা সহিংসতার মধ্যে ৫ অগাস্ট শেরপুর সদর থানা ছেড়ে পুলিশ সদস্যরা পুলিশ লাইন্সে আশ্রয় নেন। পুলিশ সদ্যস্যরা থানা থেকে সরে যাওয়ায় পর পরই সদর থানার হামলা হয়। সেখানে ভাঙচুর-লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
আগুনে বিভিন্ন মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি ও সরকারি কাগজপত্র, আসবাবপত্র, মামলার আলামত নগদ টাকা ও গাড়ি পুড়ে যায়। পুলিশদের থাকার কোয়ার্টার থেকে মালামাল ও জানালার গ্রিল লুট করা হয়েছে।
পাবনা : সোমবার পাবনা শহরের জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। শহরের নিমাই চন্দ্র ঘোষের মালিকানাধীন ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবু ইসহাক শামীমের প্যারাডাইস সুইটস, শ্যামল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, আওয়ামী লীগ নেতা সেলিমের সি-লাইন পরিবহনের গ্যারেজ ও কাউন্টারে হামলা-ভাঙচুর করা হয়।
ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ খানের বাসা, জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক শিবলী সাদিকের কার্যালয় এবং বাসায়।
চাটমোহর প্রেসক্লাবের সহসভাপতি ও দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রতিনিধি সঞ্জিত সাহা কিংশুক ও চাটমোহর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক চাটমোহর বার্তার প্রকাশক ও সম্পাদক এস এম হাবিবুর রহমানের বাড়িতেও ভাঙচুর হয়েছে। ভাঙ্গুড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল ইসলামের বাড়িতে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ করা হয়।
একই দিন ঈশ্বরদীতে ছাত্র-জনতার একটি আনন্দ মিছিল শহরের স্টেশন রোডের উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, পোস্ট অফিস মোড়ে উপজেলা যুবলীগ ও আলহাজ মোড়ে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে।
বেড়া ও সাঁথিয়ায় জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকুর বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার বাড়িতেও আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। সাঁথিয়া পৌর এলাকায় অবস্থিত সাঁথিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এমটিআই