• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ধারণার বাইরে বন্যার আঘাত, বাড়ছে মৃত্যু-ক্ষতি


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ২৪, ২০২৪, ১২:২৭ পিএম
ধারণার বাইরে বন্যার আঘাত, বাড়ছে মৃত্যু-ক্ষতি

ঢাকা : মাসের শুরুতে পূর্বাভাস থাকার পরও মাসের শেষভাগে দেশের ১১টি জেলায় ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ বন্যার আঘাতে বিপর্যয়ের চিত্র ধারণা চেয়েও বেশি, যা নিয়ে উপদ্রুত অঞ্চলের পাশাপাশি সারা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) পর্যন্ত বন্যায় নতুন করে তিনটি জেলাসহ ১১টি জেলা প্লাবিত হওয়ার তথ্য দিয়ে সরকার জানাচ্ছে, ১৫ মৃত্যুসহ প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।

বহু ঘরবাড়ি-অবকাঠামো ধসে যাওয়া, বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের ফসলের ক্ষতি এবং ভৌত ও ভার্চুয়াল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার মধ্যে পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষের কষ্ট ও হাহাকারের তথ্য আসছে।

কিছু এলাকায় পানি নামা শুরু হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধিরও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) রাতে সর্বশেষ সার্বিক প্রতিবেদনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলেছে, শুক্রবার নতুন করে লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার ও সিলেট জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।

আবহাওয়া অফিস থেকেও মিলছে না ‘সুখবর’, তারা জানাচ্ছে নতুন করে ভারি বা অতিভারি বৃষ্টিপাত না হলেও আপাতত চলমান ধারার ‘বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা নেই’। এ অবস্থায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন বন্যা উপদ্রুত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।

ঘরবাড়ি থেকে ফসলের ক্ষেত- সর্বত্র বন্যার আঘাত, দিশেহারা শত শত গ্রামের মানুষ, উৎকণ্ঠায় কৃষক ও বর্গা চাষি। জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাও তাদের ভাবাচ্ছে।

আশ্রয়কেন্দ্র, উঁচু রাস্তা ও অবকাঠামাতে গরু-ছাগল, হাসমুরগির সঙ্গে ‘দলা পাঁকিয়ে’ বসবাস করতে হচ্ছে বন্যাকবলিত অঞ্চলের মানুষের। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগও নেই। চারদিকে থই থই পানি অথচ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছে বানভাসি মানুষ।

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাগাদি সোবহানপুর এলাকার কৃষক জাহাঙ্গীর বলেন, সেচ প্রকল্প এলাকায় অনেক কৃষক বর্গা চাষি। অন্যের জমি চাষ করে তাদের সংসার চলে। টানা বৃষ্টিতে রোপা আমন পানির নিচে। পানি অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেকে বীজ রোপণ করতে পারেননি। এমন ক্ষতি আমরা ধারণাও করতে পারিনি।

বুধবার (২১ আগস্ট) মধ্যরাতে হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে পানির তোড়ে ঘরবাড়ি ভেসে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের খলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা নারগিস আক্তারের।

ক্ষয়ক্ষতির এমন ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে কোনো ধারণা ছিল নাগিস আক্তারের। তিনি বলেন, কোনো জিনিসপত্রই রক্ষা করতে পারি নাই। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। পানিতে ঘরের জায়গার মাটি সরে যাওয়ায় নতুন করে এখন ঘরও বানাতে পারব না।

ঘরে বানের পানি ওঠায় হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া মো. আব্দুল হাই বলেন, বাড়িঘরে পানি ওঠার পাশাপাশি আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখন অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছি।

প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ আক্রান্ত, ১৫ জনের মৃত্যু : বর্ষা মৌসুম শেষে ভাদ্রের শুরুতে দেশ যে আরেক দফা বন্যার কবলে পড়তে পারে, অগাস্টের শুরুর দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসেই সেটি বলেছিল। কিন্তু সেই বন্যা যে এমন রুদ্ররূপে আবির্ভূত হবে, তা কল্পনাও করেনি ফেনীসহ আক্রান্ত অন্যান্য জেলার মানুষ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অতিভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক এই বন্যায় দুই দিনের ব্যবধানে দেশের অন্তত ১১টি জেলা প্লাবিত হয়ে পড়ে। এসব জেলায় প্রায় ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৯টি পরিবারের মানুষ এখন, সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ জন মানুষ।

বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে মন্ত্রণালয়টি।

কিন্তু মুহুরী নদীর বানে ফেনী জেলা যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, ইতিহাসে এমন নজির আর নেই। সম্পদহানির সঙ্গে ফেনীর চার উপজেলার চার লাখের বেশি মানুষ এখন প্রাণ বাঁচানো নিয়ে লড়াই করছে।

দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় দুজন নারীসহ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৪ জন, ফেনীতে ১ জন, চট্টগ্রামে ৪ জন, নোয়াখালীতে ১ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন ও কক্সবাজারের ৩ জন রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যা উপদ্রুত জেলাগুলো হচ্ছে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার।

এর মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত জেলা হলো সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার।

বন্যায় ১১টি জেলার ৭৭টি উপজেলা প্লাবিত ও ৫৮৯টি ইউনিয়ন-পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্যাকবলিত অঞ্চলে ৩ হাজার ১৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যেখানে ঠাঁই হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩০ মানুষের। ১৮ হাজার ৯৬টি গবাদিপশুরও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উপদ্রুত জেলাগুলোতে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য মোট ৬৩৯টি মেডিকেল টিম গঠন করারও তথ্য দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এসব এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে।

১১ জেলার বাইরেও ভারি বৃষ্টি ও স্রোতে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আসছে। যার মধ্যে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার উচাখিলা ইউনিয়নে একটি লোহার সেতু ভেঙে পড়ার তথ্য এসেছে। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ১৫ গ্রামের অন্তত ২০ হাজার মানুষ।

রাজশাহীতে পদ্মাসহ চার নদীর পানি বাড়ছে। জেলাটির পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এনামুল হক বলেন, শুক্রবার প্রতি তিন ঘণ্টায় এক সেন্টিমিটার করে পদ্মা নদীতে পানি বেড়েছে। এদিন সকাল ৬টায় পদ্মার রাজশাহী পয়েন্টে পানির লেভেল ছিল ১৬ দশমিক ২০ মিটার। সন্ধ্যা ৬টায় সেটি বেড়ে হয়েছে ১৬ দশমিক ২, মিটার। যা বিপৎসীমার ২ দশমিক ২৬ মিটার নিচে।

প্রায় সাড়ে ৩ লাখ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি : বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর পাশাপাশি বন্যার পানি ঢুকে পড়া অন্যান্য জেলা মিলে মোট ২৪টি জেলার ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯২২ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের শুক্রবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ লাখ ২৯ হাজার ৪২১ হেক্টর অর্জিত ফসলি জমির মধ্যে বর্তমানে ‘মাঠে দণ্ডায়মান’ ফসলি জমির পরিমাণ ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৬ হেক্টর।

ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির মধ্যে রয়েছে আউশ ৬৮ হাজার ৫১১, রোপা আপন আবাদ ২ লাখ ৩৪ হাজার ২৯৩, বোনা আমন ১ হাজার ৬৩৭, রোপা আমনের বীজতলা ১৮ হাজার ৯৫২, শাকসবজি ১৪ হাজার ১১১, আদা ১৪৭, হলুদ ১৯৮, আখ ৬১৮, পান ৪৫৬, কলা ১৬৭৬ হেক্টর।

বাঁধ খুলে দেওয়ার আগে বাংলাদেশকে জানানোর অনুরোধ করবে সরকার : ভবিষ্যতে ভারত যখন বাঁধ খুলে দিয়ে পানি ছাড়বে, তার আগে যেন উজানের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অবহিত করা হয়, সেই বিষয়টি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে (ভারত) জানানো হবে বলে মন্তব্য করেছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) বিকালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মশাজানে খোয়াই নদীর বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের (ভারত) সঙ্গে যদি চুক্তি নাও থাকে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের দেশ হিসেবে ভারতের পানি ছাড়ার আগে আমাদের জানানোর কথা। কিন্তু এবার সেটি প্রতিপালিত হয়নি।

তবে এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অভিন্ন নদীগুলো দিয়ে পানি ছাড়ার আগে যেন বাংলাদেশকে জানানো হয়, এ ব্যাপারে ভারতের কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছানো হবে।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান রেখে শুক্রবার (২৩ আগস্ট) কুমিল্লা সার্কিট হাউজে সরকারের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, আমি আমার এক মাসের বেতন প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছি।

সকল পক্ষের কাছে আমাদের এ আহ্বানটা থাকবে। সবাই যদি আমরা এভাবে এগিয়ে আসি তাহলে অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত সময়ের মধ্যে মোকাবেলা করতে পারব।

এখনও অচল দেড় হাজার টাওয়ার : বন্যার কারণে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের ১০টি জেলায় প্রায় দেড় হাজার মোবাইল টাওয়ার অচল হয়ে পড়ার তথ্য দিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি।

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) বিকালে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বেলা ৩টা পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত ১০টি জেলার ১৩ হাজার ৪৯১টি সাইট বা টাওয়ারের মধ্যে ১১ হাজার ৮১২টি সাইট সচল আছে। আর অচল হয়ে পড়েছে ১ হাজার ৪২৮টি।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত টাওয়ার রয়েছে ফেনীতে; এই জেলায় ৯৪ শতাংশের বেশি টাওয়ার এখন অচল। জেলাটির ৬৫৩টি টাওয়ারের মধ্যে ৬১৬টিই অচল হয়ে গেছে, বলেছেন মোস্তাফিজুর রহমান।

নোয়াখালীতে ২২৬, লক্ষ্মীপুরে ৫৬, কুমিল্লায় ৩৪৮, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০, চট্টগ্রামে ৯১, খাগড়াছড়িতে ৩৬, হবিগঞ্জে ১, মৌলভীবাজারে ৩৬ ও সিলেটে ৮টি টাওয়ার কাজ করছে না বলে বিটিআরসি তথ্য দিয়েছে।

আক্রান্ত জেলাগুলোর পরিস্থিতি : বন্যায় কুমিল্লায় গোমতী নদীরক্ষা বাঁধ ভেঙে পুরো বুড়িচং উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের পানিবন্দি মানুষ বিশুদ্ধ পানি আর খাবার সংকটের কারণে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়েছেন।

পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে লোকালয় থেকে পানি নামতে শুরু করলেও কমেনি দুর্ভোগ।

বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাত থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে নতুন করে আর কোনো গ্রাম প্লাবিত হয়নি। এ ছাড়া হাওড়া নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। তবে এখনও পানিবন্দি অবস্থায় আছেন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ।

বর্তমানে হাওড়া নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে তথ্য দিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাউবো।

অন্যদিকে, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বঙ্গেচর, আব্দুল্লাহপুর, খলাপাড়া, বাউতলা, আড়িয়ল ও কালিকাপুরসহ প্রায় ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পানির তোড়ে উপজেলার কর্নেল বাজার ও খলাপাড়া এলাকায় হাওড়া নদীর দুটি বাঁধ ভেঙে গেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুর আহমেদ জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত হাওড়া নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার কমেছে। এতে উন্নতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির।

বৃষ্টি না থাকায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। তবে নিচু এলাকা হওয়ার কারণে দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রাম এখনও পানিবন্দি।

মেরুং ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ঘনশ্যাম ত্রিপুরা বলেন, বন্যায় ইউনিয়নের অন্তত ৪০ গ্রামের মানুষ এখনও পানিবন্দি। মেরুং বাজারে রয়েছে পানি।

হবিগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ১৪ হাজার ৩৪০টি পরিবারের ৫৭ হাজার ৫৬০ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত মানুষদের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

মঙ্গলবার রাত থেকে হবিগঞ্জ ও সংলগ্ন ভারতের ত্রিপুরায় ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে হবিগঞ্জ শহরতলীর জালালাবাদ এলাকায় খোয়াই নদীর বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি প্রবেশ করছে।

বানের পানিতে তলিয়ে গেছে রিচি, জালালাবাদ, ছোট বহুলা, সুলতান মাহমুদপুর, নোয়াগাঁওসহ আশপাশের গ্রামগুলো। তলিয়ে গেছে হাওরের বিস্তীর্ণ আমন খেত।

এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প এলাকার চাঁদপুর সদর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলায়। এতে বেশি ক্ষতি হয়েছে রোপা আমন, আখ ও মৌসুমি সবজির।

কৃষি বিভাগ বলছে, জেলা জুড়ে রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কল্লোল কিশোর সরকার জানান, উপজেলার সেচ প্রকল্প এলাকায় চার দিনের টানা বৃষ্টিতে ফসলি জমিগুলো প্লাবিত হয়েছে। একই সঙ্গে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বীজতলা।

এছাড়া, টানা বৃষ্টিতে উপজেলার সেচ প্রকল্প এলাকায় প্লাবিত হয়েছে অর্ধশতাধিক মাছের ঘেরও।

এসব ঘেরের কোটি টাকার মাছ এখন পাশের ডাকাতিয়া নদীতে। মৎস্য চাষে দেশের চতুর্থতম উপজেলা ফরিদগঞ্জ। উপজেলার সবচেয়ে বড় মাছের ঘেরগুলো ডাকাতিয়া নদী সংলগ্ন ধানুয়া গ্রামে।

এসব ঘেরের মূল উদ্যেক্তাদের মধ্যে অন্যতম সাইফুল ইসলাম বলেন, উপজেলার ৪০ জন বড় খামারির ঘেরে কয়েকশ’ কোটি টাকার মাছ ছিল। কয়েক লাখ টাকার জাল দিয়েও আমরা মাছ রক্ষা করতে পারি নাই। সব ডাকাতিয়া নদীতে চলে গেছে। আমরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।

ভারী বৃষ্টিতে কক্সবাজারে ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছে আরও ১জন। একই সঙ্গে বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে জেলার অন্তত ৫০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।

জেলার রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুল জব্বার বলেন, আমার পার্শ্ববর্তী ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বজুমছড়ি কবরস্থান সড়ক পার হতে গিয়ে আমজাদ হোসেন পানির স্রোতে ভেসে যায়। পরে কিছু দূর এলাকা থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়ন থেকেও বাঁকখালী নদীর পানির স্রোতে রবিউল আলম নামের একজন ভেসে যাওয়ার খবর আমরা পেয়েছি। আমার ওয়ার্ডের ২৫০ পরিবার পানিবন্দি। সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কারও চুলায় আগুন জ্বলছে না।

তিনি বলেন, বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ ও জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বাঁকখালী নদীর ভাঙনে এসব এলাকার বাসিন্দারা হুমকির মুখে পড়েছে।

ধীরগতিতে উন্নতি হলেও বৃষ্টি কমার ‘সম্ভাবনা’ নেই : ফেনী, কুমিল্লাসহ পাঁচ জেলায় ধীরগতিতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার তথ্য দিয়েছে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সকালে কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাগুলোতে ভারি বৃষ্টিপাত হয়নি। সেই সঙ্গে উজানের নদ-নদীর পানির সমতল হ্রাস পাওয়া শুরু করেছে।

তাতে করে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির ধীর গতিতে উন্নতি হচ্ছে বলে পাউবো তথ্য দিয়েছে।

আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে বুলেটিনে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের মনু, খোয়াই ও ধলাই নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

এদিকে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানেও ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময়ে ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

তবে, দেশের ১১ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে চলমান বৃষ্টির ধারা কমার কোনো ‘সুখবর’ দিতে পারেনি আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আগামী তিন দিন বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা নেই বলে তথ্য দিয়েছেন আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন।

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) এক বিফ্রিংয়ে তিনি বলেন, আগামী ৭২ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের যে পরিস্থিতি বিশেষ করে পূর্বাঞ্চল বা উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং দেশের ভূখণ্ডের ভেতরে যে বৃষ্টিপাত, সেটা উন্নত হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

প্রধান উপদেষ্টার তহবিলে অনুদান আহ্বান : বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য সারাদেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সমাজসেবী সংস্থা, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে আগ্রহীদের অনুদান জমা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য-সহায়তা প্রদানের জন্য অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন। বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই মহতী আগ্রহকে সরকার স্বাগত জানাই।

আগ্রহীরা অনুদান জমা দিতে পারবেন এই হিসাবে: প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল, সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট শাখা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, হিসাব নম্বর: ০১০৭৩৩৩০০৪০৯৩।

দুর্গতদের সহায়তায় সেনাবাহিনী, নৌ, বিজিবি সদস্যদের এক দিনের বেতন প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে।

এসব বাহিনীর সদস্যরা বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি চিকিৎসা সেবাও দিচ্ছেন।

সমন্বয় সেল গঠন : বন্যা মোকাবেলায় ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহায়তা সমন্বয় সেল’ গঠন করার কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সমন্বয় সেল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে প্রাপ্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে।

প্রয়োজনে ০২-৪৭১১৮৭০০, ০২-৪৭১১৮৭০১, ০২-৪৭১১৮৭০২, ০২-৪৭১১৮৭০৩, ০২-৪৭১১৮৭০৪, ০২-৪৭১১৮৭০৫, ০১৩১৭৭৪৯৯৮০ এবং ০১৮২০১১৭৭৪৪ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

এর আগে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে।

তথ্য ও সহযোগিতার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ০২৫৫১০১১১৫ নম্বরে ফোন করা যাবে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করার কথা বলা হয়েছে সরকারের তরফে। দুর্গতদের ০১৩৩১৮২৩৪৯৬২, ০১৭৬৫৪০৫৫৭৬, ০১৫৫৯৭২৮১৫৮ ও ০১৬৭৪৩৫৬২০৮ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। সহায়তার প্রয়োজন হলে ফোন করা যাবে ০১৩১৮২৩৪৫৬০ নম্বরে।

আর বন্যার মধ্যে টেলিযোগাযোগ সেবা সচল রাখতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করার কথা বলেছে বিটিআরসি।

বিটিআরসির ইমার্জেন্সি রেসপন্স দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে +৮৮০২২২২২১৭১৫২ নম্বরে ফোন করতে হবে। বিটিআরসির কল সেন্টার ১০০ ব্যবহার করেও ওই দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!