ঢাকা : বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন, যা পরে নাম দেওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। তবে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর শেখ হাসিনার সরকার দমননীতি প্রয়োগ ও গুলি চালানোর অভিযোগে পরবর্তীতে তা পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে।
জুলাই-আগস্টে দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহত হয়েছে অনেকে। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। তাদের ওপর এমন নির্যাতন চালানো হয়েছে যে আন্দোলন ও বিজয়ের এক মাস হয়ে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেন না অনেকে।
আন্দোলনে সম্মুখে থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন। যেখানে উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের ওপর তৎকালীন প্রসাশনের বর্বর নির্যাতনের চিত্র।
২৩ বছর বয়সী ইফতেখার আলম আইনের ছাত্র। জুলাইয়ে শুরু হওয়া আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি এবং প্রধান আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুও তিনি। সিএনএনের কাছে আলম তুলে ধরেছেন তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া ও নির্যাতনের চিত্র।
যেদিন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন পাঁচ তলা অ্যাপার্টমেন্টে ঘুমাচ্ছিলেন আলম। কিন্তু ভোরে তার দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। প্রায় ছয়জন সশস্ত্র পুলিশ অফিসার অশ্লীল চিৎকার করতে করতে তার বাসায় প্রবেশ করে এবং তাকে বলে যে সে বাংলাদেশের জাতির প্রতি অন্যায় করেছে।
পুলিশ অফিসাররা আলমের দিকে তাদের বন্দুক তার দিকে তাক করে এবং চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে, “তোমার ফোন কোথায়? তোমার ল্যাপটপ কোথায়?"। তাঁরা আলমের পুরো অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালায়। আলম বলেন, "তারা পাগলের মতো করছিল, সত্যিই পাগল।
আলম জানান, পুলিশরা তাকে একটি কালো কাঁচের গাড়িতে বসিয়েছিল এবং সাথে সাথেই তাকে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। পড়ে তার চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
শিক্ষার্থী আলম বিশ্বাস করেন যে তাকে আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেটি ঢাকায় ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এর সদর দপ্তরের একটি কুখ্যাত আটক কেন্দ্র।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সেখানে শত শত মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছিল।
আলমকে নির্যাতনের বর্ণনা : আলমকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদে আন্দোলনকারী নেতাদের অবস্থান জানাতে আলমকে চাপ দেওয়া হয়। সে সময় তার অপহরণকারীরা তাকে "নিখোঁজ" করার হুমকি দেয় এবং যদি সে তথ্য না জানায় তাহলে তাকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়।
আটক থাকা অবস্থায়, নিরাপত্তা কর্মীরা ঘন্টার পর ঘন্টা অত্যাচার করেছে আলমকে। তার সারা শরীরে ধাতব পাইপ জাতীয় বস্তু দিয়ে পেটানো হয়েছিল। এমনকি পায়ের হাড় না ভাঙ্গা পর্যন্ত পেটানো হয় আলমকে। শরীরে আঘাত এবং পায়ের হাড় ভাঙ্গা সত্ত্বেও তাকে বারবার বৃত্তাকারে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। এক পর্যায়ে ব্যথায় বমি করে দেন তিনি।
আলম জানান শুধু মারধর নয়, নিরাপত্তা কর্মীরা তার হাত ও পায়ে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকাও দিয়েছিল। তিনি ব্যাথায় চিৎকার করলে আরও শাস্তি দেওয়া হত। আর এসব নির্যাতনকে "খেলা" হিসেবে দেখত নিরাপত্তা কর্মীরা।
আলম বলেন, নির্যাতনের পরের ধাপটি ছিল বৈদ্যুতিক শক এবং ওয়াটারবোর্ডিং। তার ঘাড়ের পিছনে একবার বৈদ্যুতিক শক দেওয়াও হয়েছিল।
আলম তখন ভেবেছিলেন যে সেখান থেকে হয়তো রেহাই পাবেন না তিনি। জীবন সেখানেই শেষ হবে তার। এবং কেই জানতেও পারবে না।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখা দ্বারা পরিচালিত সারাদেশে অন্যান্য গোপন কেন্দ্রগুলোতে আটকদের নির্যাতন করা হয়েছিল।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অনুমান, শেখ হাসিনার শাসনামলে ৭০৯ জনকে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছিল। কয়েকজনকে পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সাজা দেওয়া হয়েছে বা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে এখনও ১৫৫ জন নিখোঁজ রয়েছে।
আলম জানান, শেখ হাসিনা পতনের কয়েক ঘন্টা পর এবং তাকে আটকের ২৪ ঘণ্টা পর তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। তার অপহরণকারীরা তাকে ভোরের আগমুহূর্তে একটি নিরিবিলি রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়,
মুক্তি পাওয়ার প্রায় এক মাস পার হলেও এখনও ক্রাচে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে আলমকে। নিজে থেকে হাঁটতে পারছেন না। শারীরিক আঘাত একসময় সেরে গেলেও মানসিক আঘাত সারতে অনেক বেশি সময় লাগবে বলছেন তিনি। সেইদিনকে দুঃস্বপ্নের সাথে তুলনা করছেন আলম।
প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা লক্ষ্যবস্তু ছিল : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম। ২৩ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়েন। আন্দোলনের সম্মুখ সারিতেই ছিলেন তিনি এবং একসময় প্রশাসনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
তিনি জানান, তিনটি দরজা ভেঙে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শারীরিক অত্যাচারেরও শিকার হয়েছিলেন তিনি।
তাবাসসুম বলেন, ২৮ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ দিন আটক থাকার সময় তাকে খুব মারধর করা হয়। তবে মুক্তির পরদিন তিনি আবারও বিক্ষোভে যোগ দেন।
তাবাসসুম বলেন, তাকে চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মারধর করা হয়েছে, যার ফলে তার মুখ কেটে যায় এবং তার কানের পর্দা ফেটে গেছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে কানের শ্রবণযন্ত্র ছাড়া ডান কানে শুনতে পান না তিনি। মারধরের কারণে দুটি দাঁত ছিদ্র হয়ে গেছে।
তাবাসসুমকে অন্য পাঁচ সমন্বয়কের সাথে আটক করা হয়েছিল এবং তাদেরকে দিয়ে একটি যৌথ স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, "তারা আমাদের একটি ভিডিও বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছিল যে আমরা আমাদের আন্দোলন স্থগিত করে দিয়েছি এবং আর কোন আন্দোলন হবে না। তার মতে, মারধরের চেয়ে সেই ভিডিওটি তৈরি করা "আরও বেদনাদায়ক" ছিল, কারণ তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা বোধ করবে।
তাবাসসুম জানান, ‘শেখ হাসিনা সরকার পতনের সংবাদ পাওয়ার পর আমি অনেক কেঁদেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল যে আমি আমার পুরো জীবন সেই মুহুর্তের জন্য বেঁচে ছিলাম।"
এখনও সেই নির্যাতন থেকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তাবাসসুম। তিনি স্মৃতিশক্তি হ্রাসের সাথে লড়াই করছেন এবং মারধরের আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি স্মরণ করতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন৷
কিন্তু তিনি নতুন দেশ বা "বাংলাদেশ ২.০" গঠনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সিএনএন বলছে, নতুন নেতৃত্বে দেশ পরিবর্তিত হবে বলে আশাবাদ রয়েছে জনগণের, তবে বর্তমানে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এ সময়ে জনসাধারণকে ধৈর্য ধারণের জন্য বলেছেন কারণ তার সরকার "১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের" পরে "পাহাড়ের মতো চ্যালেঞ্জ" মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে।
তাবাসসুম বলেন, বিপ্লব পরবর্তী সংস্কার খুবই কঠিন। আমার দেশ অসুস্থ, তবে আমাদের জনগণ আর আমরা এক সাথে দাঁড়াব।
এমটিআই