ঢাকা: ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ঢালাও ভাবে মামলা নিচ্ছে থানা। দেশের পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে ঢালাও মামলা ও গ্রেপ্তারের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হলেও থানাগুলো তা আমলে নিচ্ছে না। ফলে নানা ধরনের মামলা এখনো হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনার বাইরেও অনেকে নিজের স্বার্থে অন্যকে হয়রানি করতে মামলা করছেন। পুলিশ কোনো ধরনের যাচাই বাছাই ছাড়া এসব মামলা নিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ব্যাবসায়িক স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে একজন ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। যার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। পুলিশ এসব মামলা আমলেও নিচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে যা ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধেও এমন মামলা হচ্ছে। এতে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মামলা হওয়ার অর্থ যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়। অতি উৎসাহী ও স্বার্থান্বেষী মহল ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে। উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, সরকার যখন বিচারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘকে সত্য অনুসন্ধানে আহ্বান জানিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় কিছু অতি উৎসাহী ও স্বার্থান্বেষী মহল আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এবং প্রতিবাদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোরপূর্বক পদত্যাগ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বেআইনি তল্লাশি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ, আদালতে আসামিকে আক্রমণ করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
সরকার সবাইকে আশ্বস্ত করতে চায়, মামলা হওয়ার অর্থ যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনার পরদিন গত বুধবার রাজধানীর পল্টন থানায় একজন জনশক্তি ব্যবসায়ী তার ব্যাবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ১০০ জন জনশক্তি রপ্তানিকারকের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের একটি মামলা করেছে। এছাড়া সরকারি জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেলকেও এই মামলার আসামি করা হয়েছে। আফিয়া ওভারসিসের স্বত্বাধিকারী আলতাব খান এই মামলা করেছেন। তিনি নিজেও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি করেন। আসামি করা হয়েছে যে ১০০ জন জনশক্তি রপ্তানিকারককে তারাও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি পাঠান। ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্বে এই মামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অন্য ব্যবসায়ীরা। অথচ পুলিশ যাচাই বাছাই না করেই মামলাটি রেকর্ড করেছে। এই মামলায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অন্য ব্যবসায়ীরা।
এবিষয়ে জনশক্তি রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্ট একজন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই ধরনের মামলা আমলে নেওয়া হলে জনশক্তি রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যার প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে এই ধরনের মামলাগুলো যাচাই বাছাই করে নেওয়া। তা না হলে ব্যবসায় অস্থিরতা বাড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থিতিশীল না হলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঐ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সরকার নিপীড়নের বিচার করতে বদ্ধপরিকর। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
এদিকে বিজিএমইএয়ের শীর্ষ আট নেতাসহ ১৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে, অজ্ঞাত আরো ৩০০-৪০০ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী মো. হাসেন আলী একজন রিকশাচালক। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট আহত হন তিনি। গত রোববার বাদী পেনাল কোডের ৩০৭, ৩২ ও ৩৪ ধারায় উত্তরা পশ্চিম থানায় এ মামলা করেন। তবে মামলায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে জানেন না বলে দাবি করেছেন বাদীর পরিবারের সদস্য।
হাসেন আলীর স্ত্রী হাসি বেগম বলেন, আমার স্বামী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক আইনজীবী এসে তার সই নিয়ে যায়। বলে যায়, তার ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করবে। তবে এই মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে, কেন করা হয়েছে—এসব বিষয়ে তারা কিছু জানেন না।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, রিকশাচালক হাসেন আলী গত ৪ আগস্ট আজমপুর আমীর কমপ্লেক্সের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর ছোড়া গুলিতে তিনি আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
চিকিৎসা শেষে গত ২১ আগস্ট তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়। এ মামলায় ব্যবসায়ী নেতাদের আসামি করার বিষয়ে হাসি বেগম বলেন, আমরা জানি না কারা আসামি। এসব কিছু আইনজীবী ভালো জানেন। ঐ আইনজীবীর নাম-পরিচয় বা ফোন নাম্বার কিছুই তাদের জানা নেই।
কীভাবে এই মামলা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বলেন, বাদী তিন-চার দিন থানায় এসেছেন মামলা করতে। তিনি এনআইডি নিয়ে এসে বলেছেন মামলা করবেন। আমরা মামলা নিয়েছি।
এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পোশাক রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। এজাহার নাম থাকা আট জনের কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। এদের একজন বলেন, আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা দেওয়াটা খুবই হাস্যকর। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। কিন্তু কে বা কারা আমার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছেন তা আমার জানা নেই। মনে হচ্ছে, আমাকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এবং ব্যাবসায়িক সুনাম নষ্ট করার লক্ষ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই মামলায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সূত্র-ইত্তেফাক
আইএ
আপনার মতামত লিখুন :