ঢাকা: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল ‘ফ্যাসিবাদের সব বৈশিষ্ট্য’ দেখিয়েছে। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে দলটির আপাতত কোনো স্থান নেই। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূসের এই মন্তব্য স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, ৮৪ বছর বয়সী শান্তিতে নোবেলজয়ী এই নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে। তবে তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেবে না, যাতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্ভাব্য কূটনৈতিক উত্তেজনা এড়ানো যায়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তবে আপাতত নিশ্চিতভাবেই তার (শেখ হাসিনা) বা আওয়ামী লীগের জন্য বাংলাদেশে কোনো জায়গা নেই। তারা জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল, রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো ফ্যাসিবাদী দলের থাকার অধিকার নেই।’
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনার ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে শাসনামলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকেই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে। দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা উচিত, দলে সংস্কারে বাধ্য করা উচিত, নাকি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত- এ নিয়ে জন পরিসরে বিপরীতমুখী আলোচনা রয়েছে।
ড. ইউনূসের অনুমান, আওয়ামী লীগ ভেঙে পড়তে পারে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার এই দলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না। কারণ ‘অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সরকার নয়।’
ড. ইউনূসের মতে, ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতেই। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিসর রাজনৈতিক দলগুলোকেই নির্ধারণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা ভারতে কোথায় আছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ যেকোনো সময় নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত।
নিজের রাজনৈতিক অভিলাষ এবং জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার বা রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো ইচ্ছা তার নেই। তবে তিনি নির্বাচনের সময়সূচি সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাজ হলো, বিষয়গুলো ঠিক করা এবং একটি নতুন সংস্কার এজেন্ডা তৈরি করা। যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে, আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সে বিষয়ে (নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে) পরামর্শ করব।’
ভারত ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় বিদেশি সমর্থক। আওয়ামী লীগের পতনের পর ঢাকা–নয়াদিল্লি সম্পর্ক অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ড. ইউনূস বলেছেন, তার সরকার শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। তবে কেবল তখনই যখন দেশের আদালত (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) তার বিরুদ্ধে রায় দেবেন। চলতি মাসেই ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে অভিযুক্ত...রায় ঘোষিত হলে, আমরা দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। আমি মনে করি, রায় হওয়ার আগে আমাদের এ বিষয়ে কিছু করার নেই।’
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গত আগস্টে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছিলেন, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সহিংসতা চালিয়েছেন, এই অভিযোগ মিথ্যা। তবে তিনি যে কোনো অভিযোগের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত, ‘কারণ, তিনি অবৈধ কিছু করেননি।’
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে ড. ইউনূসের নেতৃত্ব সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বারবার প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া অনেকেই মনে করেন, এই সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গঠিত। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক বিদেশে পালিয়ে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন। প্রতিশোধমূলক সহিংসতার কারণে অনেকে নিহতও হয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জুলাই–আগস্টে আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারী, সাধারণ মানুষ এবং পুলিশসহ প্রায় ৮০০ জন নিহত হয়েছেন।
তবে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, হিন্দুদের বিরুদ্ধে ‘হত্যাকাণ্ড’ সংঘটিত হয়েছে- ভারতের এমন অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ড. ইউনূস স্বীকার করেন যে, হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কিছু ঘটনা ঘটেছে এবং ‘খুব অল্পসংখ্যক’ মানুষ এতে নিহত হয়েছেন। তবে তিনি যুক্তি দেন, এই সহিংসতা ধর্মের জন্য নয় বরং তাঁরা আওয়ামী লীগ সদস্য হওয়ার কারণে হয়েছে।
দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, ‘আগস্টে যেসব হিন্দু আক্রমণের শিকার হয়েছেন তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন।’ এ সময় তিনি আরও অভিযোগ করেন, সমালোচকেরা এসব ঘটনার কাহিনি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে বিদ্যুৎ, যৌথ নদীর পানি বণ্টন এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত প্রকল্পের মাধ্যমে সম্পর্ক বিদ্যমান। এসবের পাশাপাশি দুই দেশের সাধারণ একটি ইতিহাসও আছে। এসব সম্পর্কের কারণে নয়াদিল্লি অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব একটা সমর্থন না করায় এই সরকার ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে।
এ সময় তিনি জানান, মোদি বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইলে তাঁকে ‘স্বাগত’ জানানো হবে। ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি, এটি বোঝাতে যে-আমরা প্রতিবেশী, আমাদের একে অপরের প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই প্রতিবেশী হিসেবে ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে।’
এসএস
আপনার মতামত লিখুন :